পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

265 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড মুজিবুর বলেছিলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, তখন আরো দেব-কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।” বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যে হয়নি। সেই সে মার্চ মাস থেকে রক্তদান শুরু, বাংলার মানুষ এখনো জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য রক্ত দিয়ে চলেছে। কিন্তু এই রক্ত ও প্রাণদান এখন আর একতরফা নয়। বাঙালীর হাতে এখন অস্ত্র। বাংলাদেশের যুবশক্তি এখন মুক্তিবাহিনীতে রূপান্তরিত। তাদের হাতে রোজ খতম হচ্ছে শত শত হানাদার সেনা। তাই গভীর প্রত্যয়ে বুক বেঁধে আজ আমরাও বলতে পারি- “রক্ত দিয়েছি, আরো দেব। ইনশাআল্লাহ গোটা বাংলাদেশকে পাকিস্তানী হানাদারদের কবলমুক্ত হয়ে ছাড়বো।” গত ছ'মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তিনটি ফ্রন্টে বিস্তৃত হয়েছে। যুদ্ধ এখন আর একটি ফ্রন্টে সীমাবদ্ধ নয়। এই তিনটি ফ্রন্ট হচ্ছে- এক, রণাঙ্গনে সম্মুখযুদ্ধ এবং দখলকৃত এলাকায় ক্রমবর্ধমান গেরিলা তৎপরতা। দুই অর্থনৈতিক ফ্রন্টে প্রত্যক্ষ অসহযোগিতা। তিন বিশ্বব্যাপী জনমত সৃষ্টি এবং ইসলামাবাদের জঙ্গী ফ্যাসিষ্ট চক্রের উপর ক্রমাগত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি। হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের সাফল্যের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় সেপ্টেম্বর মাসের শেষ তিনদিনের যুদ্ধের কথা। এই তিনদিনের যুদ্ধে ১১৯ জন খানসেনা নিহত হয়েছে। ঢাকা শহরের অদূরে ইছামতী নদীতে হয়েছে আরো চমকপ্রদ যুদ্ধ। কয়েকটি লঞ্চযোগে সশস্ত্র হানাদার সৈন্যকে যখন নদী অতিক্রমের চেষ্টা করছিল, তখন নদীর উভয় তীর থেকে মুক্তিবাহিনী মেশিনগানের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় দলে দলে গ্রামবাসী। ফলে বহু হানাদার সৈন্য নিহত হয়। পাঁচজন আহত সৈন্যকে গ্রামবাসী পিটিয়ে মেরে ফেলে। অবশিষ্ট লঞ্চগুলো দ্রুত পলায়ন করে। পদ্মা ও ইছমতী নদীতে এ পর্যন্ত হানাদার সৈন্য বোঝাই একুশটি লঞ্চ ও অন্যান্য যান হয় ধ্বংস, নয় ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। ঢাকা শহরের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও হানাদার সৈন্যদের জন্য খুব ভীতিপ্রদ। শহরের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার বাঁশ ও লোহার ডাণ্ডা দিয়ে রোড ব্লক করে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। রাতে গেরিলাদের চলাচলে বাধা দেয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু রাতে গেরিলারা যখন সত্য সত্যই অপারেশনে বের হন, তখন তাদের ভয়ে বীরপুঙ্গব খানসেনারা আর ঢাকার রাস্তায় থাকেন না। তারা ব্যারাকে গিয়ে আশ্রয় নেন। অবাঙালী রাজাকারদের বাধ্য করা হয় এই রোডব্লক পাহারা দিতে। এটা গেল সম্মুখযুদ্ধ ও গেরিলা তৎপরতার কথা। এবার অর্থনৈতিক ফ্রন্টের যুদ্ধের খবর শুনুন। বাংলাদেশে কোন বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্য কিনছে না। ফলে হাহাকার উঠেছে বাইশ পরিবার ও অবাঙালী ব্যবসায়ী মহলে। বাংলার চাষী পাট বুনছে না, ধান বুনছে- ফলে কারখানায় বাঙালী মজুর উৎপাদন চালাচ্ছে না। ফলে কি দাঁড়িয়েছে, তারই একটা হিসাব দিয়েছেন ইকোনমিক টাইমস’ পত্রিকার রিসার্চ ব্যুরো। তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “পাকিস্তানের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়তে যাচ্ছে। শিল্পোৎপাদন, কৃষি উৎপাদন, বৈদেশিক মুদ্রা ও বিদেশী মুদ্রা আয়ের পথ ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হওয়ায় পাকিস্তান এক দারুণ অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে। বাংলাদেশ থেকে পাট রপ্তানি শতকরা ৮০ ভাগ কমে গেছে। পাকিস্তানের সমগ্র বিদেশী মুদ্রার শতকরা পয়তাল্লিশ ভাগই আসে বাংলাদেশের পাট রপ্তানি করে। এছাড়া আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যে ২৫০ কোটি টাকারও বেশী ক্ষতি হয়েছে। একদিকে এইভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি অন্যদিকে বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে ইয়াহিয়ার ফ্যাসিষ্টচক্রের মাসে খরচ হচ্ছে পয়তাল্লিশ কোটি টাকা। ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে যেখানে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে ছিল ২২ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারে। গত দু’মাসে এই তহবিল আরো শূন্য হয়েছে। অন্যদিকে রপ্তানির আণ্ডারইনভয়েসিং ও আমদানীর ওভার-ইনভয়েসিং এর দরুণ বিদেশে পাকিস্তানের মূলধন দেদার চলে যাচ্ছে। বৃটেন ও ফ্রান্স পাকিস্তানে রপ্তানি সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। ওদিকে আবার খবর প্রচারিত হচ্ছে, বিশ্বব্যাঙ্ক কনসরটিয়াম ইয়াহিয়া চক্রকে আবারো জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত, তাদের কোন সাহায্য দেয়া সম্ভব নয়।