পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

267 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড ক্যাম্পে যখন পৌঁছলাম তখন বেলা সাড়ে তিনটা চারদিকে সারি সারি টেন্ট খাটানো। প্রায় আধমাইল দূরে কোলাহলমুখর বসতি। আমরা এতদূর থেকেও আবছা দেখতে পাচ্ছিলাম প্রতিটি ঘরের চালে ও গাছের ডালে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছিল। ক্যাম্পে দেখলাম এক জায়গায় কতগুলি ছেলে তাদের অস্ত্র পরিষ্কার করছে। কেউ কেউ তাদের জুতোর কাদা ধুয়ে ফিতে পরাচ্ছে, আবার এক জায়গায় কয়েকজন মিলে জয়বাংলা পত্রিকা পড়ছে। সবার চোখে মুখে যেন একটি ভাষাই সোচ্চার, সবার মনেপ্রাণে একই দৃঢ়তা ও প্রত্যয়। দেখে মনে হলো এরা সবাই যেন এখনই জীবনাৰ্ণবের অমৃত উৎসে অবগাহন করে উঠেছে। হঠাৎ দেখলাম পাশের একটা টেণ্ট থেকে একটা কিশোর চপল হরিণের মত চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে এলো। ওর দিকে তাকিয়ে আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। ওর গভীর অতল চোখগুলো দেখে মনে হলো যে-কোন মুহুর্তে সেগুলো জুলে উঠতে পারে নির্মম দহনে। ছেলেটাকে দেখে আমার এত ভাল লাগল যে আমি আলাপ করার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “তোমার নামটা কি?” প্রথমে কোন উত্তর করল না। তার চোখে স্পর্শ দিয়ে আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে রইল। মনে হলো ও যেন আমার কপালের ত্ৰিবলী আর মুখের বিভিন্ন রেখার মাঝে কী এক পাঠ্য খুঁজে পেয়েছে। আর তাই পড়ে নিচ্ছে নিঃশব্দে। কিছুক্ষণ পর একটু আত্মস্থ হয়ে বলল- ‘নাম? আবার একটু থেমে বলল “আমার নাম জানেন না? আমরা তো আমাদের সবার নাম জানি। আমাদের সবার নামই তো এক- বাঙালী” চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে। সম্বিৎ ফিরে পেলাম ওর কথায়। ও বলল, “আপনি তো রিপোর্টার।” আমি বললাম, “হ্যাঁ। শুনলাম মুক্তিবাহিনীর মাত্র তেরজন গেরিলা আড়াইশ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য মেরেছিল। এবং আমিও তাদের মধ্যে একজন ছিলাম। যদি আপনার ইচ্ছা হয়,আমার থেকেও সব ব্যাপার জানতে পারেন।” আশ্চর্য হয়ে গেলাম, এত বড় সাহসিকতার যে সেও একজন ভাগীদার তাতে তাঁর কোন বিকার নেই। এগুলি যেন এখন তাদের কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপার। আমি আরো ঘন হয়ে ঘাসের উপর বসলাম। সে বলতে রইলঃ গত পরশু দিন আমাদের মেজর এসে খবর দিলেন পাকিস্তানী বাহিনীর কয়েক ব্যাটেলিয়ন নিয়ে আড়াইশ জনের মত সৈন্য বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলের অদূরে অধিকৃত এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছে। একথা শোনার পর আমরা সবাই তাদের খতম করতে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম। পেয়েছিল হানাদার বাহিনীর সাথে এল-এম-জি, এইচ-এম-জি প্রভৃতি ছাড়াও তিন ইঞ্চি মর্টার আছে। আমরা সেইভাবে প্রস্তুত হয়ে রওয়ানা দিলাম শত্রর ঘাটির দিকে। যখন সেই জায়গাটায় পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা হয় হয়। জায়গাটা একটু উচুনিচু ও টিলাবহুল। কিছুটা দূরে কী এক বড় নদীর এক ক্ষীণ শাখা প্রবাহিত। বহু দূরে দেখা যাচ্ছিল শত্রর ক্যাম্পের নিম্প্রভ ও কম্পিত শিখা জানেন, সেদিকে চোখ পড়তে আমাদের রক্ত এত চঞ্চল হয়ে উঠল, শত্রহননের জিঘাংসা এত প্রবল হয়ে উঠল তা আপনি বুঝতে পারবেন না। এ তো ভাষায় বোঝান সম্ভব নয়, জন্তু হত্যা করায় এত আনন্দও আছে। কিন্তু আমাদের সে অধৈর্য কমাণ্ডারের আদেশে প্রশমিত করতে হলো। ঠিক হলো রাত সাড়ে এগারটার দিকে আমরা আক্রমণ চালাব। কমাণ্ডার আমাদের দলের দু’জনকে নিয়ে শক্রক্যাম্পের জায়গাটা পরিদর্শন করতে গেলেন। প্রায় আধঘণ্টা পরে তারা ফিরে এসে আমাদের জানালেন পরিস্থিতি আমাদেরই অনুকূল এবং আমাদের আক্রমণ চালাতে হবে, A.B.C এই তিন পদ্ধতিতে। তখন রাত সাড়ে আটটা। আরো তিনঘণ্টা, ১৮০ মিনিট, কত সহস্র সেকেণ্ড উফ ভাবতেও অসহ্য লাগল। এত সময় কীভাবে কাটাব, ঐ নোংরা পাপী পশুগুলি আরো দুঘণ্টা বাংলাদেশের নির্মল পবিত্র বাতাসে নিঃশ্বাস টানবে। ভাবতেও গা রী-রী করে জুলে উঠল। কিন্তু কমাণ্ডারে আদেশ। একচুলও এদিক-ওদিক করার জো নেই। বসে রইলাম দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে। সদ্য পানিতে ফেলা এ্যাসপিরিন ট্যাবলেটের মত চাঁদটা ঝুরো ঝুরো লঘু মেঘের ভেতর ঢুকে গলে যাচ্ছে, আধো আধো হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়েছিলাম। নাকে ভেসে আসছিল অদূরের ঝোপ থেকে কোন বনফুলের গন্ধ। হঠাৎ গ্যাছে।