পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

27| বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড দশমাস আগেও যিনি ছাত্রদের নিয়ে ক্লাসে বসতেন, আজ তাদেরকে নিয়েই তিনি বৈরীদের মুখোমুখী লড়াই করতে বসেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেনঃ কি লাভ, কি হবে স্কুলে, যদি ভবিষ্যতের ছাত্রদের না বাঁচানো যায়। একটা আশ্চর্য দেশপ্রেম এবং সাহস ভদ্রলোককে আজ এতখানি দুর্বার করে তুলেছে যে অন্ততঃ একটা রাত দেখলেন না ঘুমিয়ে- মুক্তিবাহিনীর সরবরাহ কর্মে কাটিয়ে দিলেন। আমার মনে হোল শিক্ষকরা মহান, কিন্তু ক্যাপ্টেন শাজাহানের মত নিরলস শিক্ষকরা? নিশ্চয় ভবিষ্যৎ জবাব দেবে। শাজাহান মাস্টার সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন শরীফপুর গ্রামে। গ্রামটি খুবই ভালো। অবাক বিস্ময়ে আমি লক্ষ্য করলাম গ্রামে একটা বাড়িও নেই। আমার চোখকেই যেন ক্ষণমুহুর্তের জন্য বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কোনো কোনো পোড়া ঘর থেকে তখনও মৃদু মৃদু ধোঁয়া উঠতে দেখলাম। গ্রামের অস্তিত্বটাই যেন হরণ করেছে কোন এক পাষাণ দানব। ক্যাপ্টেন শাজাহান সাহেব বললেনঃ হ্যাঁ-এই গ্রামের এগার হাজার লোকের বাসযোগ্য গৃহাদি ছিল। কিন্তু এখন আপনি দেখছেন- তার একটাও নেই। আমি মাষ্টার সাহেবের দিকে তাকালাম। তিনি বললেনঃ দীর্ঘ বাইশ ঘণ্টা তীব্র সংঘর্ষের পর পাক-হানাদাররা পিছু হটবার সময় সব বাড়িতে পেট্রল ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। আমরা মাত্র চার ঘণ্টা আগে এই গ্রাম দখল করেছি। এক বৃদ্ধাকে দেখিয়ে তিনি বললেনঃ এর নাম রতন। বৃদ্ধ ধীরে ধীরে আমাদের কাছে এলেন। চোখে তাঁর অশ্রুধারা। ঠোঁট দুটো একটু নড়লো। কোন শব্দ উচ্চারিত হোল না। আবার ফিরে গেলেন। মাষ্টার সাহেব জানালেন, বৃদ্ধার পেশা ছিল দুধ বিক্রী করা। চারটে গাই গরুই ছিল তার সম্বল। এবারে আসুন আমার সাথে। শাজাহান সাহেব আমাকে যে গোয়ালঘরের কাছে নিয়ে এলেন সেখানে সে কি বীভৎসতা, কি দুর্গন্ধ- চারটে গরুর বিকৃত পোড়া দেহ পড়ে আছে। চার ধারের মাটিতে পোড়া চর্বির তেল গড়িয়ে গড়িয়ে ভিজিয়ে তুলছে। নাকে কাপড় চেপে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। আমি বললাম, ক্যাপ্টেন সাহেব আমার বড় খারাপ লাগছে। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলুন। ভাঙ্গা ধরা গলায় ক্যাপ্টেন শাজাহান কথা বললেন। আমি চমকে উঠলাম। তিনি বললেনঃ ও, আপনি আমার এক ছাত্রের বৃদ্ধা আচল মাকে ওরা ঘরে পুড়িয়ে মেরেছে তা দেখবেন না? তারপর বললেনঃ আর কটাই বা দেখবেন? ওরা যেখানে যেখানে যাচ্ছে সর্বত্র গ্রাম, ধানের গাদা, গরুর গোয়াল, পাটের ঘর, সাঁকো, পুল সবই তো জুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শুধু একটা শরীফপুর গ্রামই না-এমন বহু শরীফপুর ওরা প্রতিদিন তৈরী করছে। কিন্তু আপনি জেনে রাখুন, আমরা আবার গড়ে তুলবো পোড়া ঘর ভাঙা ভিটেগুলোকে। কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার চোখ চলে গেল বড় একটা ভিটের ওপর, যেখানে ঘরের চারকোণের চারটে পোড়া ফাটা কাঠই অবশিষ্ট আছে- আর সব ফাঁকা। আমার মনে হোল এই ফাঁকা ঘরকে এরা একদিন ভরাট করবে, এই পোড়া নির্জনতার বুক চিরে এরা তুলে আনবে জীবনের স্পন্দন, নির্মাণ করবে পুনরায় সেই শান্তির নীড়-ছোট ছেলে-মেয়েদের কলকাকলিতে আবার ভরে উঠবে ঘরের আনাচ-কানাচ, সোনার বাংলায় আবার জেগে উঠবে সোনার গ্রাম। সেই সাধনায় এরা রত-রত শিক্ষক, রত ছাত্র, রত গ্রামের কৃষক-শ্রমিক। সন্ধ্যা হলে এলো। ভাবছিলাম এবার আমাকে ফিরতে হবে। এমন সময় সাইকেলে একজন লোক এলো। হাতে তার একটা ভাঙ্গা সাইকেল। ক্যাপ্টেন সাহেবকে জানালেনঃ আমাকে মাফ করবেন, এক্ষুণি আমাকে অগ্রবর্তী ঘাঁটির দিকে যেতে হচ্ছে যে ছেলেটি এসেছিলো তাকে দেখিয়ে বললেনঃ ওর নাম মৃণাল কান্তি মুখার্জি ও আমার অত্যন্ত স্নেহের ছাত্র ছিল। এখন ও একজন মুক্তি সৈনিক ও খুব সাহসী যোদ্ধা। একবার দেবহাটা থানায় ও এগার জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ১০০ জন পাকবাহিনীকে পিছু হটিয়ে দিয়েছিল। ১৮ জনকে হত্যা করেছিল। লেঃ মৃণাল বাবু আমাকে হাত বাড়ালেন। তার সাথে পরিচয় হোল। তার ডান আর বাম হাতে ব্যান্ডজ বাঁধা। বললাম, এ কেন? তুচ্ছভাবেই জবাব দিলো যোদ্ধা মৃণালঃ কয়েকদিন আগে দুই হাতে হারামীদের ব্রাশ