পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

275 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড সামনে মনে হলোঃ বীর আলেকজাণ্ডারের গ্রীকবাহিনী যে বিজয়যাত্রার দৃপ্ত পদধ্বনিতে সাফল্যকে অতিক্রম করেছিল এখন সেই বাহিনীরই আরেক রূপ। এদের যাত্রা যেন শুধু সফলতার ইঙ্গিতকেই চেনে। শুধু বিজয়ের যাত্রাকেই স্বীকার করে। একেকটা বাহিনী একেকটি এলাকা থেকে এসে একটু থেমে আবার যাত্রা করছে। শত্রর সাথে ওরা কেউ হয়তো বারো ঘণ্টা বুঝেছে, কেউ তিরিশ ঘণ্টা। তারপর সে জিতেছে- শত্রকেহারিয়েছে, বিবেকের সম্মান আদায় করেছে। সবাই এসে মিলিত হয়েছে। এতক্ষণ ওরা লড়েছে। কিন্তু কেউ বিশ্রাম চায় না। তাই আবার ওদের যাত্রা শুরু। অকস্মাৎ একটি রবে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো। ওরা যাত্র করছে কোথায়? ওদের ধ্বনিতে ওরা জানায়ঃ চলো চলো, ঢাকা চলো। কুর্মিটোলা ভাঙো, ভাঙো শত্রদের, হানো হানো। এখানে দীর্ঘ সতের ঘণ্টা পশ্চিমী হানাদাররা লড়ছে। অতঃপর তারা মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। গ্রামের লোকেরা মুক্তিবাহিনীর সাথে সক্রিয় সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন। এখন ওদের তারা খাওয়ার পালা। এখন ওদের পরাজয়ের পালা। রণবিধ্বস্ত বাগেরহাটের অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে আলাপ হল নবম সেক্টরের কমাণ্ডার মেজর জলিলের সাথে। তিনি দেখলাম দারুণ ব্যস্ত। মাথায় একটা সবুজ ক্যাপ, পায়ে বুট, এক হাতে একটা দূরবীন এবং অন্য হাতে একটি ষ্টিক। আমাকে দেখে ষ্টিক উঠিয়ে বললেনঃ জয় বাংলা। আমি তাঁর কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলামঃ শত্রদের ক্ষয়ক্ষতি কি পরিমাণ? ছোট্ট জবাবে বললেনঃ বহু। তারপর বামহাত দিয়ে ষ্টিক তুলে হাত বিশেক দূরে নির্দেশ করলেনঃ দেখুন। একটা মিলিটারী জিপ বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তার মধ্যে তিনটে রক্তাক্ত নিম্প্রাণ হানাদার, একজনের মাথাটা আছে কি নেই বোঝা মুস্কিল- দেখা শেষ না হতেই কমাণ্ডার জলিল সাহেব ষ্টিকটা আরেকটু ডাইনে সরিয়ে আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললেনঃ ঐ বাঙ্কারে ওদের কমপক্ষে বিশটা লাশ পড়ে আছে। একটু সামনে ডাইনে সরে গিয়ে দেখলামঃ হানাদারদের সেই দুর্ভেদ্য বাঙ্কারের মধ্যে থেকে তখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে- আমাদের মুক্তিবাহিনীর সৈনিকদের শেল এসে বাঙ্কারটা দুমড়ে মুচড়ে গুড়িয়ে দেয়। নবম সেক্টরের কমাণ্ডার জলিল সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ এবার আপনি বলুন ক্ষয়ক্ষতি। কমাণ্ডার সাহেব এরপর কয়েকটি গ্রুপকে কারো ফিরে যেতে দেইনি। আমাদের আরো দ্রুত সম্মুখপানে যেতে হবে। ওদের কারো ফিরতে দেয়া হবে না। সুতরাং বাংলার এই মুক্তিবাহিনীর এই অপ্রতিরোধ্য গতিকে না থামিয়ে সামনে চলার গতিকে আরো দ্রুতময় করে তুলবো আমরা। হেসে আমাকে বললেনঃ চলি, জয় বাংলা। বাংলাদেশের পতাকা হাতে ট্রপ এগিয়ে যাচ্ছে সামনে, পশ্চাতে উড়ছে ধূলি, তার পাশ দিয়ে কমাণ্ডারের গাড়ি এগিয়ে গেল। মুক্তিবাহিনীর পশ্চাতে বিকেলের শেষ সূর্যের বিদায়ী রঙ কাত হয়ে পড়েছে- তারা চলে গেল- দূরে, অনেক দূরে- একসময় চোখের নিশানার ওপারে- এখানে তখনও শত্রদের বাঙ্কার থেকে কালো ধোঁয়ার রেশ উঠছে, চারদিকে শত্রদের মৃতদেহ পড়ে, পড়ে বিধ্বস্ত সামরিক যান, তার ওপর চার-চারটি হানাদারের নিম্প্রাণ দেহ আরো ওপাশে হানাদার বাহিনীর একটি তাঁবুর ভস্মাংশ, তারও ওপাশে পশ্চিমা দসু্যর একটা ভগ্নকামান, দুটো বিক্ষত ট্রাক, ট্রাকের ওপর দিয়ে তখনও রাবারপোড়া ধোঁয়া উঠছে। এখানে হানাদাররা ছিল। এখন হটছে তারা। চোখ তার ওপারে এক বৃদ্ধার এবং গ্রামের আরো কতকগুলো পুরুষরমণীর দিকে ফিরে গেল। তারা এতসময় আমাদের মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন কর্মে সহযোগিতা করছিলো। এবার তারা সবাই সমস্বরে ‘জয় বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে গ্রামের দিকে ফিরছে। আমি এগিয়ে গেলাম। সবাই গ্রামের দিকে ফিরছে, কিন্তু এক বৃদ্ধা, সাদা একমাথা চুল, নিশ্চপ দাঁড়িয়ে ততক্ষণে। বৃদ্ধার দৃষ্টি তখনও সেই পথপ্রান্তে- যেদিক দিয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনীর ভায়েরা এগিয়ে গেছে। বৃদ্ধার মুখের ওপর চোখ পড়তেই দেখলাম, তাঁর চোখে অশ্রুধারা। জিজ্ঞেস করলামঃ কি মা, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বৃদ্ধাটি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেনঃ “আমার মণি গেছে যুদ্ধে। খানদের খতম করে ও শহরে ফিরবে।’ তারপর তাঁর কণ্ঠস্বর আর আমি শুনতে পেলাম