298 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড মহামূল্য প্রাণটি বাঁচাতে- একথা ভাবতে চোখের জলে ঝপসা হয়ে এল তার সামনের দৃশ্যাবলী। এখন, এই বিষগ্ন রাতে, তার মনে পড়ল কয়েকদিন আগের একটি অনিশ্চয় রাত্রিকে।
- আমার বড় ভাবনা হচ্ছে। অন্তরঙ্গ শয্যায় সরমা বলেছিল তাকে।
তা ভাবনা হবারই কথা। যদিও শহর থেকে যাত্রী বোঝাই লঞ্চের আসা যাওয়া হঠাৎ করেই বন্ধ হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই। বাতাসে ভেসে ভেসে অনেক মন-কেমন-করা গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল দক্ষিণ খুলনার সুদূর নিস্তরঙ্গ এই গ্রামটিতেও। একটা প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়েছে নাকি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা মিলিটারি আর বাংলাদেশের শহর গঞ্জে বাস করা মানুষগুলোর মধ্যে। কারণটা কি, ওরা সঠিক জানে না কেউ- কেবল গ্রামের একমাত্র কলেজে পড়া ছেলে রফিকের কথাবার্তা থেকে একটা ধোঁয়াটে উপলব্ধির প্রান্তসীমায় পৌঁছেছে ওরা। হাতে টাকা নেই, মাঠে ফসল ফলে না, অনাবৃষ্টি বন্যা অনাহার, দুঃস্বপ্নের অনাবাদী বছরে নিষ্ঠুর দারিদ্র্য দাওয়ায় উঠে বসে পাওনাদারের মত- এ সবকিছুই নাকি পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তাদের ষড়যন্ত্রের ফল। যে বিপুল ষড়যন্ত্রে বিরান হয়ে যায় উর্বর, বর্ধিষ্ণু জনপদ- ফলবতী হয়ে ওঠে আজন্মের অনুর্বর মরুভূমিও। বছরের পর বছর অত্যাচার, অনাচার আর শোষণের অবসান ঘটাতে এই জীবনান্ত যুদ্ধ। আর এ যুদ্ধে আমরা বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ জিতবই- রফিকের কণ্ঠে বলিষ্ঠ প্রত্যয় ঝলমল করে।
- আমার বড্ড ভাবনা হচ্ছে। সরমা আবার পুনরাবৃত্তি করে।
ভাবনা আবার কিসের? সরমাকে নয়, যেন নিজেকেই সান্তনা দিতে চেয়েছে জীবন শহরে নাকি তুমুল কাণ্ড হচ্ছে। ক্ষ্যাপা কুকুরীর মত হয়ে গেছে মিলিটারী। মানুষ পেলেই গুলি। কোন বাছবিচার নেই। সরমার গলায় উদ্বেগ স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। তা শহরে যাই হোক গাঁয়ে তার কি? আমাদের এখানে ত আর যুদ্ধ হচ্ছে না। জীবন সান্তনা দিতে চেয়েছে। কিন্তু যদি হয়?
- পাগল! এই অজপাড়াগাঁয়ে মিলিটারী আসপে মরতি? আর কার সঙ্গে যুদ্ধ করবে এখেনে?
সব আশঙ্কাকে জোর করে সরিয়ে পাল্টা এক প্রত্যয়ের প্রশ্নকে বউয়ের দিকে ছুড়ে দিয়েছে জীবন। চুপ করে গেছে সরমা। গত পরশুর ভয়ঙ্কর সকালের কথা মনে পড়ল এখন। যথারীতি সূর্য উঠেছিল, নদী থেকে এলোমেলো হাওয়া উঠে এসে গ্রামের গাছপালা, বাড়িঘর, মানুষগুলোকে ছুয়ে যাচ্ছিল। সেই প্রশান্ত সকালে আকাশে অনেক সঞ্চারণশীল মেঘ চোখে পাড়েছিল এবং স্পষ্ট মনে আছে জীবনের, বাড়ির পাশের গাছপালা থেকে যথারীতি পাখিদের ডাকাডাকি শুনেছিল ঘুম থেকে উঠেই। মুখ-হাত ধুয়ে, দু’মুঠো পান্তা খেয়ে, রোজকারের মত রফিকদের বাড়িতে হাজির হয়েছিল। এই আসাটা প্রায় একটি অভ্যেসে পরিণত হয়ে পড়েছিল বেশ কিছুদিন থেকেই- কর্যত শহরে গণ্ডগোল শুরু হবার পর থেকেই। কেবল জীবন নয়, গ্রামের অনেকেই রফিকদের বাড়িতে ভিড় করত রেডিওর খবর শুনতে। রফিকদের বাড়িতে পৌছে জীবন শুনতে পেল রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর হচ্ছে এবং তার চারপাশে ছোটখাটো একটি উৎসুক জনতা। খান সেনারা মার খাচ্ছে। ক্রমাগত জিতে চলছে মুক্তিবাহিনী,