পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/৩২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

30| বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড সাজিয়ে নিচ্ছে। গোলাপজান ত্রস্তে একবার ঘরের ভেতরটা দেখে নিল। মেঝেতে তখনও অঘোরে ঘুমুচ্ছে তার বছর পাঁচেকের ছেলেটা। ওকে নিয়ে ঠিক এই মুহুর্তে গোলাপজানের এতো ভীতি। গতকাল রাতে যখন ওর সামনে একটা আধপোড়া শুকনো রুটি ও খেতে দিয়েছিল, তখন ছেলেটা কিছুতেই তা গিলতে চায়নি। ওর একমাত্র জেদ ভাতই খাবে আর কিছু নয়। শেষ পর্যন্ত গোলাপজান সকালেই ভাত রেধে দেবে বলে বহু সাধ্যসাধনা করে রুটিটা খাইয়েছিল। এখন, যদি ও উঠেই জেদ ধরে এই আশংকায় যতোক্ষণ কলিমুদ্দিন ঘরের ভেতর ছিল, গোলাপজান ওর সাথে কথা বলেনি। বারান্দায় আসতেই ও স্বামীর উদ্দেশে বলে উঠল আইজ তুমার ফেরীতে জাওনের কাম নাইক্যা।’ ‘ক্যান, কি অইছে, ঘরেত চাউল নাই, খাওনের কিছু নাই, এডডা পয়সাও নাই, হে খেয়াল আছে? এমতেই আইজ দশদিন বাইর অই নাই, প্যাটেত খাওন লাগবো না?” থাউকগা অবাবর, তুমারে বাড়িত থাকন লাগবো, আমারে ডর করতাছে।’ ‘ডর! কি তামাসা করতাছস, ডর কিয়ের লাইগ্যা? মেলেটারি, আমারে দেইখ্যা খাড়াই গ্যালো, আর চিকখোর পাইড়া, এশারা কইরা কি যান কইব্যার লাইগলো, তারপর আমারে ছটপটাইয়া বাড়িত যাওন দেইক্যা তাগোর কি হাসি। হাচা কইতাছিগো, ডর লাগতাছে, তুমি যাইও না।’ ‘তোক তাগোর মনে লাগছেরে সোন্দরী, আর আমগো বাবনা কিরে, তোর কপালটা ফির্যাই গ্যাল। আচ্ছা থাউক, আমি যাইগ্যা।’ বিক্রির উদ্দেশ্যে রাস্তায় নামলো। শহরে এমনিই মানুষজন কম। মিলিটারীদের সাথে শেখ সাহেবের দলের কি একটা গোলমালে সমস্ত সম্পত্তি। ভালো ভালো ঘরের মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। রাস্তাঘাটে অনেক ধর্ষিতা মৃতদেহে একটা ভ্যাপসা পচা কটুগন্ধে ওর মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে। শহর জনশূন্য। কৃচিৎ-কদাচিৎ কোন বাড়িতে দেখা যায় বুড়ো অথবা আধৰুড়ো দাড়িটুপিওলা এক-আধজন মুরুববী চেহারার লোক। শহরের সব লোক পালিয়ে গেছে গ্রামে। পথচলিত দু’একটা লোকের মুখে কলিমুদিন এ খবরও পেয়েছে, শহরের লোক গ্রামে চলে যাওয়ায় এখন মিলিটারীদের লক্ষ্য গিয়ে পড়েছে গ্রামে। তারা শহরে যে সমস্ত অত্যাচার চালিয়েছে, এখন ব্যাপক হারে তা চালাচ্ছে গ্রামে। হঠাৎ এসব কথা ভাবতে ভাবতে কলিমুদিনের ভীষণ হাসি পেলো। বোধ হয় একটু জোরেই হেসে উঠলো ও আরে কি বোকা সে। যেখানে শহরে মানুষ নাই বললেই চলে, যা এক-আধজন আছে, তারাও আতঙ্কে খাওয়াদাওয়া ছেড়েই দিয়েছে প্রায়, দোকানপাট-হাটবাজার সব ভস্মীভূত-ধ্বংস-প্রায়, আর এরমধ্যে সে কিনা বের হয়েছে হাঁড়িপাতিল বেচতে। আবার মাইল চারেক হেঁটে শহরতলীর বস্তিবাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতেই তার যেন ক্লান্তিতে সারা দেহ অবসন্ন হয়ে পড়লো। কি করবে সে এখন? একটু জিড়িয়ে নিয় বাড়ির দিকে হাঁটবে? কিন্তু, অন্ততঃ কিছু চাল না নিয়ে সে বাড়ির দিকেই বা যাবে কি করে? হঠাৎ এই মুহুর্তে তার ভীষণ রাগ হলো