বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/৩২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খণ্ড
304

 - হ্যাঁ, আমি, চমকে উঠলে যে বড়! এই নাও, মালাটা রাখ।

 সন্ধ্যার চোখে-মুখে দুষ্টুমি হাসি। হাতে বকুলমালা। শয্যা থেকে ওঠা সন্ধ্যার মিথিল বৈশিষ্ট্য দৃকপাত করতে অজান্তেই কেমন যেন শৈথিল্য আসে। অন্যমনস্ক হতে চায়। কিন্তু শুধুই কয়েকটি মুহূর্ত। অন্যমনস্ক চিত্ত আবার চঞ্চল হয়ে ওঠে একটি কথায়- এমন করে আমাকে দেখছ কি? আকাশের দিকে চোখ মেলে দেখ।

 ও তাই তো! আমাকে আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকাতে হবে। আমার দৃষ্টি হবে প্রসারিত। আকাশ। মাটি। স্বদেশ। ভালবাসা।

 সন্ধ্যা আমাকে ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই আমার দৃষ্টিপথ সৃষ্টি করে দিলো একটি সরল সংলাপে। আমি হাত বাড়িয়ে মালাটি নিয়ে নিলাম। নিমেষে দৃষ্টির আড়ালে মিলিয়ে গেল সন্ধ্যা।

 ‘বকুল’ ও সন্ধ্যা”। এই দুটোর মধ্যে কেমন যেন দূর অস্তিত্বের সম্পর্ক বিদ্যমান। ‘বকুল’-‘সন্ধ্যা” না হয়ে ‘মালতী’-সন্ধ্যা হতে পারত। কিন্তু সন্ধ্যা মালতী নিয়ে এল না। এল বকুল নিয়ে। প্রভাতসূর্যোদয় মুহূর্তে। একটি বকুলমালাও জীবনের মহৎ প্রেরণা।

 এমনি মহৎ প্রেরণার উৎস খুঁজে বেড়াবো। স্বদেশের লাখো লাখো সন্ধ্যা প্রভাতসঙ্গীতের সুর নিয়ে জীবনের নতুন অধ্যায় রচনা করবে। আবার চিনতে পারবো নিজেকে। উপলব্ধি করতে পারবো।

 সন্ধ্যা, এই মুহূর্তে আমি তোমার স্মৃতিচারণ করছি। তোমার সরল সংলাপ আমার মনে পড়ছে। পঁচিশে মার্চের কয়েকদিন আগে বলেছিলে, তুমি ভয়ানক ঘরকুনো। একদিন মিছিলেও যোগ দিলে না। এত ঘরকুনো আমার ভাল লাগে না- তোমার কথায় সেদিন লজ্জা পেয়েছিলাম। এ লজ্জা যে আমার দীনতা তাও বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু তোমার কাছে ঠিক সেই মুহূর্তে পরাজয়টা স্বীকার করে নিতে পারিনি। কঠিন জবাব দিয়েছিলাম- যা বোঝ না তা নিয়ে কথা বলো না সন্ধ্যা। হাউকাউ করে, মিছিলে ঘুরে স্বাধিকার পাওয়া যায় না।

 রূঢ় জবাবে তোমাকে সাময়িক স্তব্ধ করতে পেরেছিলাম হয়তো কিন্তু বিবেককে আমি ফাঁকি দিতে পারিনি। পরক্ষণেই ভীরু হৃদয় আমার সংকুচিত হয়েছিল। সন্ধ্যা, তুমি জানতে না এসব শ্লোগান মিছিল সভা শোভাযাত্রা আমার বড্ড ভয় করতো! কিন্তু আজ? তুমি জান না কেমন করে আমি জনতার মিছিলে লিখেছি আমার নাম। আমি এখন মিছিলের ভিড়ে। ছিন্নমূল মানুষের মাঝে। তুমি দেখতে পাচ্ছ না কেমন করে লাখো লাখো ছিন্নমূল প্রাণ জীবনের জয়গান করে। কেমন করে মরিয়া হয়ে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছুবার সংগ্রামে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। হয়তো তুমিও এতক্ষণে তস্করদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছ।

 জান, বুকের ভেতরটা মাঝে মাঝে কেমন যেন করে। তোমার মুখখানি মনে পড়লে একটা অজানিত আশংকায় কেঁপে উঠি। না জানি তুমি কোথায় কেমন করে আছো! অবশ্যি আমি একটি শক্তিও অর্জন করে ফেলেছি। আত্মসান্ত্বনার বিপুল শক্তি। আগে তো সপ্তাহখানেক না দেখলে কেমন ভেঙ্গে পড়তাম। কই, এখন তো আর তেমন হয় না। বলতে পার কোথায় পেয়েছি এই সান্ত্বনা। এই সংযমশক্তি। আমার মনে হয় কি জানো, এর পেছনে প্রেরণা আছে। তোমার ভালোবাসাই এই প্রেরণার উৎস।

 সন্ধ্যা, আমার অনেক আশা। হয়তো তুমি এক মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিতা। ঘরের বাইরে। ঝড় কেটে গেলে তুমিও একদিন সুন্দর একটি ঘরের মানুষ হবে। বাংলার লাখো লাখো সন্ধ্যা তোমার মতো সংলাপী হবে। তারা আমার সহোদরা। একদিন বধূ হবে। মা হবে। বীর সন্তানের জননী। তোমার মধ্যে আমি কোথায় আমার মায়ের আদল খুঁজে পাই। আমার মাও যে এমনি কথা বলে। বাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে প্রান্তরে আমি তোমার অস্তিত্ব খুঁজি। দিনমণি বিদায় নিলে আমরা অন্ধকারে জলে জলে স্থলে, কখনোবা কালো পাহাড়ের গায়ে মিলে যাই, অতন্দ্র