বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/৫২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খণ্ড

বেতার কর্তৃপক্ষ কোনদিনই তাদেরকে খুঁজে বের করতে পারবে না। কারণ, নাম-ঠিকানা সবই কাল্পনিক ছিল। সেই দিনের পত্রবিতানে এমন অনেক কাল্পনিক শ্রোতার চিঠির উত্তর দেয়া হয়েছিল যারা নাকি কষ্টিপাথর, প্লেইন ট্রুথ, ঢাকা শহর ও তার আশেপাশে প্রভৃতি অনুষ্ঠানের প্রশংসা করেছেন। কি ভয়ঙ্কর জালিয়াতি।

 ঢাকার আউট ব্রডকাষ্ট সেকশনকে ‘ঢাকা শহর ও তার আশেপাশে' এই শীর্ষক অনুষ্ঠানটি প্রযোজনা করতে হ'ত। ঢাকা এবং তার আশেপাশে যে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে তারই উপর শত্রুদের ভাষায় প্রামাণ্য অনুষ্ঠান প্রচার করা হত। যেমন ট্রেন কেমন চলছে কিংবা ফ্যাক্টরী কেমন চলছে সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার। আর ওই সাক্ষাৎকারগুলো নিতে আমাকেই যেতে হত। গেল মাসের প্রথম দিকের কথা। পোরটেবল রেকর্ডিং মেশিন নিয়ে কমলাপুর স্টেশনে গেলাম। সমস্ত স্টেশন খাঁ খাঁ করছে। ডিকেড অব রিফর্মসএর ভাষায় এশিয়ার বৃহত্তম স্টেশনের এ কি পরিণতি! জনহীন নিস্তব্ধতায় চারদিক থম থম করছিল। মনে হচ্ছিল নির্জনতার দ্বারা সমস্ত স্টেশনটা লাঞ্ছিত। টিকেট কাউণ্টারের পাশের বিরাট চত্বরটার উপর দিয়ে একমাত্র আমিই প্ল্যাটফর্মের ভেতর প্রবেশ করলাম। দু'একজন উর্দুভাষী টিকেট কালেক্টর ও দু'একজন অন্যান্য কর্মচারী প্ল্যাটফর্মে অকারণ ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দূরে দেখতে পেলাম লাইনে দাঁড়ানো নিস্তব্ধ কতগুলো কম্পার্টমেণ্ট। জানালাগুলো বন্ধ। দেখলেই বোঝা যায়, বহুদিন চাক্কা ঘোরেনি। প্রথমে স্টেশনের জনৈক পদস্থ কর্মচারীর সাক্ষাৎকার নিলাম। বুঝতে পারলাম তিনি নিরূপায় হয়েই ইণ্টারভিউ দিলেন। প্যাসেঞ্জারদেরও সাক্ষাৎকার নিতে হবে। কিন্তু প্যাসেঞ্জার পাব কোথায়? স্টেশনের কয়েকজন কর্মচারীকে প্যাসেঞ্জারের ভূমিকায় অভিনয় করালাম। তারা সবাই উর্দুভাষী। বাংলাও মোটামুটি বলতে পারেন। স্টেশনের সেই পদস্থ কর্মচারীই ব্যবস্থা করে দিলেন। সাইডিং-এ একটা ইঞ্জিন দাঁড় করানো ছিল। সেখান থেকে সাউণ্ড এফেক্ট সংগ্রহ করলাম। যথারীতি ট্রেন চলাচলের উপর প্রামাণ্য অনুষ্ঠান প্রচার করা হল। অথচ যবনিকার দুয়ারে যে অভিনয়টুকু করান হ'ল, যে সাজান মিথ্যে কথাগুলো বলান হ'ল তার হিসেব কে রাখে? এরি নাম প্রামাণ্য অনুষ্ঠান! বেয়নেটের আগায় অনেকেই বাধ্য হয়ে সাজানো সাজানো কথা তোতাপাখির মত আউড়ে গেছে। এবং সেই সব সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান ফলাও করে “ঢাকা শহর ও তার আশেপাশে” শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রামাণ্য অনুষ্ঠান হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। বর্বর ইয়াহিয়া সরকার এর মাধ্যমে প্রমাণ করতে চাইছেন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। প্রসঙ্গতঃ একটা কথা বলে রাখি, ঢাকা শহরে একটা মাত্র কারখানা পুরোদমে চলেছে। আর তা হচ্ছে ঢাকা বেতার। যেখান থেকে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে ‘মিথ্যে” ম্যানুফ্যাকচার করা হয়।

 মে মাসের ৮ তারিখে স্কুলগুলো খোলার জন্য বর্বর সরকার নির্দেশ দিয়েছিল। তিন-চারটে স্কুলে সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু কোন স্কুলে ছাত্র দেখতে পাইনি। ঢাকার কোন এক নামকরা স্কুলের গেটে দেখলাম জনা ৫/৬ ছেলে জটলা করছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পেলাম তারা ক্লাশ করতে আসেনি। এবং তারা ক্লাশ করবেও না। এমন কি স্কুলবাড়ির ভিতরে ঢুকতেও তারা ভয় পাচ্ছিল। কারণ যে কোন মুহূর্তে দু'পেয়ে পশুরা এসে তাদেরকে হত্যা করতে পারে। তবুও স্কুলের উপর প্রামাণ্য অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। দু'একজন শিক্ষক যাদেরকে বেয়নেটের ডগায় স্কুল খুলতে বাধ্য করান হয়েছিল তারাই সেই বেয়নেটের ভয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ক্লাশে কোন ছাত্রী নেই অথচ একজন শিক্ষয়িত্রী ক্লাশে পড়াচ্ছেন। এমনি একজন শিক্ষয়িত্রীর কণ্ঠস্বরও সেদিনের সেই প্রামাণ্য অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয়েছিল অথচ ছাত্রীবিহীন একটি ক্লাশকক্ষে সেই শিক্ষয়িত্রী শুধু পড়ানোর অভিনয় করে যাচ্ছিলেন। সামরিক কর্তৃপক্ষ তাঁকে এ ধরনের অভিনয় করতে বাধ্য করেছিল।

 এরই নাম স্বাভাবিকতা, এরই নাম প্রামাণ্য অনুষ্ঠান। এবং এরই নামই জালিয়াতি। ‘ডকুমেণ্টারী' নামে তারা জাল অনুষ্ঠান প্রচার করছেন। পত্রবিতান অনুষ্ঠানে তারা কাল্পনিক শ্রোতাদের কাল্পনিক চিঠির উত্তর দিচ্ছেন, সংবাদ সেখানে 'ম্যানুফ্যাকচার' করা হয়, যে কোন স্ক্রীপ্ট প্রচারের পূর্বে ইংরেজীতে অনুবাদ করে সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়; কোরানের কোন কোন আয়াত এমন কি ছুরা, হাদিসের কোন কোন অংশ বা পুরো হাদিস তারা প্রচার করতে দিচ্ছেন না। বেতারের 'প্রোগ্রাম ফাইল' ঘাঁটলে এমন