পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/৫৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

520 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড অস্তিত্ব রক্ষার আত্মপরিচয়মূলক সহজাত এবং নির্দোষ ঔৎসুক্য। অনুরূপ মানসিকতার প্রাবল্যে আমাদের ন’মাসকালের দেশ রণাঙ্গনের যাবতীয় কথা প্রায়ই হয়ে দাঁড়ায় আত্মকথা। গৌরচন্দ্রিকা আকারে এতো কথা বলতে হলো। এবার আরম্ভেরও প্রারম্ভিক হিসেবে বলতে হচ্ছে, একটা বিষয় রহস্যাবৃত থাকা পর্যন্ত তাই নিয়ে বিচিত্র বিক্ষিপ্ত জল্পনা-কল্পনারও যেমন অবকাশ আছে, তেমন অবকাশ আছে নানা রকম রটনার এবং নানা জনের ব্যক্তিগত কৃতিত্ব প্রকাশের সুযোগ-সুবিধার। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ইতিমধ্যেই একটি বহুবিতর্কিত জটিল প্রসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে একজন নগণ্য বেতার কর্মী হিসেবে আমার সর্বসময়ের বক্তব্য হচ্ছে, স্বধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার একক কৃতিত্ব কারুরই নেই। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে পারেন। তবে একথা নিদ্বিধায় বলা যায় বেতার বিভাগীয় কর্মীরাই আলোচ্য কেন্দ্রটি চালু করেছেনসেটা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই হোক কিংবা হোক রাজনৈতিক কর্মীদের প্রভাবে বা সহযোগিতায়। কেননা, বেতার মাইকের সামনে শব্দনিক্ষেপণ এবং শব্দকে ইথারে উৎক্ষেপন এই দুই কর্মই বেতারের অনুষ্ঠান ও প্রকৌশল বিভাগীয় কর্মীগণ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়া ২৫শে মার্চ, ৭১- এর পূর্বহ্নে বঙ্গবন্ধু আহুত অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে আমাদের বেতার কেন্দ্রগুলো দখলদার সরকারের সঙ্গে সত্যিকার বর্জন করে প্রত্যেক আঞ্চলিক কেন্দ্র নিজ নিজ আঞ্চলিক নাম ঘোষণা শুরু করেছিল, যেমন, ঢাকা বেতার কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র ইত্যাদি। প্রত্যেক বেতার কেন্দ্রেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছিল বাঙালী কর্মীদের সমন্বয় সংগ্রাম কমিটি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের ভাষণটি চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকেই প্রথম ৭ই মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় প্রচার করা হয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ১৫ই মার্চ, ৭১ স্থানীয় লালদীঘির ময়দানে অভিনীত গণনাটক মমতাজউদ্দীনের রচিত ‘এবারের সংগ্রাম”- এর রেকর্ড ১৭ই মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে বাজানো হয়েছিল। বেতার তথা সরকারী কর্মচারীদের কানে নিত্যই বাজাতো একটি বজ্ৰকণ্ঠের বাণীঃ বাঙালীর স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ তোমাদের করতে বলা হলে তোমরা অফিস বন্ধ করে দেবে। ঠিক তা-ই করেছিলাম ২৬শে মার্চ, ৭১ সকালবেলা চট্টগ্রাম বেতারের কর্মীরা। প্রথম অধিবেশনের শেষাংশে যে মুহুর্তে বেতারের তখনকার প্রাদেশিক অনুষ্ঠানের সামরিক প্রশাসক প্রবর্তিত বিধানের প্রারম্ভিক বেরিয়ে পড়েছিলেন। তার পরের ঘটনাগুলো অসম্ভব রকম স্বতঃস্ফূর্ত, অসম্ভব রকম বিচিত্র-বিক্ষিপ্ত। বিচিত্র কি, তখন আমাদের অনুষ্ঠানের শ্রোতারাও এরকম কিছু একটা ভাবতে পারেন, এখন যদি বেতারের বাঙালিদের সংগ্রামের সপক্ষে কিছু প্রচার করা যেতো। বস্তুতঃ অনুরূপ চিন্তা-ভাবনা থেকেই চট্টগ্রাম বেতারের ট্রান্সমিটারে বিভিন্ন পর্যায়ে একই দিনে ২৬শে মার্চ, ৭১ তিনবার স্বল্পকাল স্থায়ী তিনটি অধিবেশন প্রচারিত হয়। একবার বেলা ২ টা বেজে ৭ মিনিট আর একবার সন্ধ্যা ৭ টা বেজে ৩৫ মিনিটে এবং আর একবার রাত ১০ টায়। বস্তুতঃ এই তিনটি ঘটনাই অসম্ভব রকম বিক্ষিপ্ত এবং এগুলোর উদ্যোগ-আয়োজনও ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত- দেশে দখলদার সামরিক বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণাত্মক তৎপরতার বিরুদ্ধে যেমন সেদিন সর্বত্র গড়ে উঠেছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ, এগুলোও ঠিক তেমনি।