পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/১৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
১১৫

 নদীর গতিপথ যেমন নির্দেশ করে দেওয়া যায় না, ভাষারও তেমনি। একমাত্র কালই ভাষার গতি নির্দিষ্ট করে। ভাষার রীতি (Style) ও গতি কোন নির্দিষ্ট ধরাবাঁধা নিয়মের অধীন হতে পারে না। ফরাসী ভাষার বলে Le style c’est I homme ভাষার রীতি সেটা মানুষ অর্থাৎ মানুষে মানুষে যেমন তফাৎ, প্রত্যেক লোকের রচনাতেও তেমনি তফাৎ থাকা স্বাভাবিক। এই পার্থক্য নির্ভর করে লেখকের শিক্ষাদীক্ষা, বংশ এবং পরিবেষ্টনীর উপর। মোট কথা, ভাষা হওয়া চাই সহজ, সরল এবং ভাষার রীতি (Style) হওয়া চাই স্বতঃস্ফূর্ত্ত, সুন্দর ও মধুর। এ সাধনার ধন ঘসে-মেজে রূপ আর ধরে-বেঁধে পীরিত যেমন, নিয়ম বেঁধে ভাষার রীতি শেখানও তেমন। অবশ্য প্রয়োজনবোধে (খামখেয়ালিতে নয়) সংস্কৃত, আরবী, পারসী, ইংরেজি, জার্ম্মান, রুশ যে কোন ভাষা থেকে আমাদের শব্দ ধার করতে হবে। কিন্তু আমাদের দুটি কথা স্মরণ রাখা উচিত- ভাষা ভাব প্রকাশের জন্য ভাব গোপনের জন্য নয়; আর সাহিত্যের প্রাণ সৌন্দর্য্য, গোঁড়ামি নয়।

 কিছু দিন থেকে বানান ও অক্ষর সমস্যা দেশে দেখা দিয়েছে। সংস্কারমুক্তভাবে এগুলির আলোচনা করা উচিত এবং তার জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরামর্শ সমিতি গঠন করা আবশ্যক। যাঁরা পালী, প্রকৃত ও ধ্বনিত্ত্বর সংবাদ রাখেন, তাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য যে, বাংলা বানান অনেকটা অবৈজ্ঞানিক, সুতরাং তার সংস্কার দরকার। স্বাধীন পূর্ববাংলায় কেউ আরবী হরফে, কেউ বা রোমান অক্ষরে বাংলা লিখতে উপদেশ দিচ্ছেন। কিন্তু বাংলার শতকরা ৮৫ জন যে নিরক্ষর, তাদের মধ্যে অক্ষরজ্ঞান বিস্তারের জন্য কি চেষ্টা হচ্ছে? যদি পূর্ববাংলার বাইরে বাংলা দেশ না থাকত আর যদি গোটা বাংলা দেশে মুসলমান ভিন্ন অন্য সম্প্রদায় না থাকত, তবে এই অক্ষরের প্রশ্নটা এত সঙ্গীন হত না। আমাদের বাংলাভাষী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। কাজেই বাংলা অক্ষর ছাড়তে পারা যায় না। পাকিস্তান রাষ্ট্র ও মুসলিম জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনীয়তা আমরা স্বীকার করি। তার উপায় আরবী হরফ নয়; তার উপায় আরবী ভাষা। আরবী হরফে বাংলা লিখলে বাংলার বিরাট সাহিত্য ভাণ্ডার থেকে আমাদিগকে বঞ্চিত হতে হবে। অধিকন্ত আরবীতে এতগুলি নূতন অক্ষর ও স্বরচিহ্ন যোগ করতে হবে যে বাংলার বাইরে তা যে কেউ অনায়াসে পড়তে পারবে, তা বোধ হয় না। ফলে যেমন উর্দু ভাষা না জানলে কেউ উর্দু পড়তে পারে না, তেমনই হবে বাংলা।

 বিদেশীর জন্য অক্ষর জ্ঞানের পূর্বে ভাষাজ্ঞান- এমন অদ্ভুত কল্পনা এ বৈজ্ঞানিক যুগে খাটে না। মীম-য়ানুন এই বানান মে, মায়, মিয়ন, মুয়িন, মুয়ন, মীন, মেন, মুয়ন এই রকম বহুরূপেই পড়া যেতে পারে। যদি কোন বৈজ্ঞানিক অক্ষর নিতে হয়, তবে International Phonetic Script ব্যবহার করতে হয়। অক্ষর সম্বন্ধে বিবেচনা করতে হলে ছাপাখানা, টাইপ-রাইটার, শর্টহ্যাণ্ড এবং টেলিগ্রাফের সুবিধা ও অসুবিধার কথা মনে করতে হবে। বিশেষ করে আজ যখন বাংলাকে প্রাদেশিক রাষ্ট্র ভাষারূপে গ্রহণ করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণেরও সম্ভাবনা রয়েছে, তখন বাংলা ভাষায় রাজনৈতিক সম্ভাবনা ও উপযোগিতার কথা চিন্তা করারও প্রয়োজন রয়েছে। জনগণের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারের জন্য Basic English-এর মত এক সোজা বাংলার বিষয় আমাদের বিবেচনা করা কর্ত্তব্য। যদি ৮৫০টি ইংরেজী কথায় সমস্ত প্রয়োজনীয় ভাব প্রকাশ করতে পারা যায়, তবে বাংলায় তা কেন সম্ভব নয়?

 আমরা পূর্ববাংলার সরকারকে ধন্যবাদ দেই যে তাঁরা বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করে বাংলা ভাষার দাবীকে আংশিকরুপে স্বীকার করেছেন। কিন্তু সরকারের ও জনসাধারণের এক বিপুল কর্ত্তব্য সম্মুখে রয়েছে। পূর্ববাংলা জনসংখ্যায় গ্রেটব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি, স্পেন, পর্তুগাল, আরব, পারস্য, তুর্কি, প্রভৃতি দেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই সোনার বাংলাকে কেবল জানে নয়, ধনে-ধান্যে, জ্ঞানে-গুণে, শিল্প-বিজ্ঞানে পৃথিবীর যে কোন সভ্য দেশের সমকক্ষ করতে হবে। তাই কেবল কাব্য ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে বাংলাকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল বিভাগে বাংলাকে উচ্চ আসন নিতে ও দিতে হবে। তার জন্য শিক্ষার মাধ্যমে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আগাগোড়া বাংলা করতে হবে।