পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/১৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
১৪৪

যে, বাধ্যতামূলক ধান্য সংগ্রহ পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান দিতে অস্বীকার করায় প্রায় একশত জনেরও অধিক কৃষককে গুলি করিয়া নিহত করা হইয়াছে। প্রকৃত ঘটনাটি এইরূপঃ

 উক্ত এলাকার হাজংদের আন্দোলন প্রায় স্থানীয় বৈশিষ্ট্যস্বরূপ: ১৯৪৬ সালে একবার তাহাদের আন্দোলন এত ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী হইয়াছিল যে, অবস্থা আয়ত্তাধীনে আনিতে বাংলা সরকারকে পুলিশ প্রেরণ করিতে হইয়াছিল। জনসাধারণের অনুন্নত অবস্থার সুযোগে টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে পুরাতন আন্দোলন পুনরায় আরম্ভ করা হইয়াছে। কমুনিষ্টদের নেতৃত্বে হাজংরা কয়েকটি সভা ও শোভাযাত্রায় টঙ্ক প্রথা, খাজনা ও ধান্য সংগ্রহের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। তাহারা বর্শা, দাও প্রভৃতি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। কয়েকবার তাহারা ধানও লুট করে। ২৮শে জানুয়ারী সীমান্ত পুলিশ দলের জনৈক নায়েক তাহাদের হস্তে নিহত হয়। একজন পুলিশ কনষ্টেবলকেও হাজংরা বেদম প্রহার করে। গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারী কমুনিষ্ট হাজংদের এক বিরাট জনতা বর্শা ও দাও প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া লেঙ্গুরা থানার পুলিশ ক্যাম্পটি পরিবেষ্টন করিয়া ফেলে। পুলিশ তাহাদিগকে ছত্রভঙ্গ করিতে অসমর্থ হইয়া গুলি চালায়। দুই ঘণ্টা পর অপেক্ষাকৃত বৃহৎ আরেকটি জনতা ঐ স্থানে জমায়েত হয়। পুলিশ তাহাদিগকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য আবার গুলি চালায়। ৯ই ফেব্রুয়ারী দুর্গাপুর ও হালুয়াঘাট থানায় দুইটি স্থানেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য। পুলিশ বারবার সাবধান করে। জনতা যখন ভীতি প্রদর্শন করে এবং অবস্থা যখন আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া যাওয়ার উপক্রম হয়, তখনই পুলিশ গুলি করে। এ পর্যন্ত মোট ১৩ জন নিহত হইয়াছে। বর্তমানে অবস্থা শান্ত।

 ১৪ই ফেব্রুয়ারী ছাত্র ফেডারেশনের[১][২] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ময়মনসিংহের হাজং কৃষকদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও কৃষক হত্যার প্রতিবাদে ১৬ই ফেব্রুয়ারী তারিখ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি ছাত্রসভা আহবান করে। মোহাম্মদ বাহাউদ্দীনের সভাপতিত্বে সভার কাজ শুরু হওয়ার পরই দেখা যায় একদল ছাত্র জোরপূর্বক সভা ভেঙ্গে দিতে বদ্ধপরিকর। এদের মধ্যে একজন ‘সভা কে আহবান করেছে সেটা জানতে চায় এবং সভাপতির হাত ধরে টেনে তাঁকে চেয়ার থেকে ফেলে দেয় এবং অন্য একজন সভাপতির চেয়ারটি পার্শ্ববর্তী পুকুরে নিক্ষেপ করে। এরপর সেই গুণ্ডা ছাত্রদল সভাটির উদ্যোক্তাদের উপর ইচ্ছেমত কিল, চড়, ঘুষি ইত্যাদি চালাতে থাকে। ফলে সভাস্থলে এক দারণ হট্টগোল গণ্ডগোলের সৃষ্টি হয় এবং সভার কাজ চালানো আর সম্ভব হয় না। এই গুণ্ডামির বিরুদ্ধে অবশ্য সভাস্থলেই একদল ছাত্র তীব্র প্রতিবাদ জানান। এঁদের একজনের একটি পত্র নওবেলালে প্রকাশিত হয় এবং তাতে তিনি বলেনঃ

 সবাই বুঝিতে পারেন, যাহারা গুণ্ডামি করিয়া সভা ভাঙ্গিয়া দেন তাহারা শুধু ছাত্র ফেডারেশনেরই শত্রু নন, তাহারা প্রত্যেকটি গণতন্ত্রকামী ছাত্র আন্দোলনেরই দুষমন। এরাই বাংলা ভাষা আন্দোলনে সরকারের দালাল সাজিয়েছিলন। এরাই জমিদারী উচ্ছেদ ব্যাপারে সরকারের জমিদার পোষণ নীতির সমর্থন করেন। সর্বোপরি এরা হাজং চাষীদের উপর গুলিবর্ষণ নীতির দিক দিয়া সমর্থন করেন।[৩]


  1. দেশ বিভাগের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিষ্ট প্রভাবাধীন একটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারী ও বেসরকরী প্রতিক্রিয়াশীলদের আক্রমণে এমই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে, তার অস্তিত্ব রক্ষা করা আর সব হয় না এবং অল্পকাল পরেই তার বিলুপ্তি ঘটে। ব,উ।
  2. এই ধরনের ছাত্র প্রতিষ্ঠান তখন ঢাকাতে একটিই ছিল। তার নাম নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। সরকার ও মুসলিম লীগের পৃষ্ঠপোষকতার এই সংগঠনের ছাত্ররাই বিরোধী দলের সভাগুলিতে সুপরিকল্পিতভাবে প্রস্তামি করলে। এদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেই দবিরুদ্দিন, নঈমুদ্দীন আহমদ, আজিজ আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল মতিন প্রভৃতি 'পূর্ব পাকিন্তান মুসলিম লীগ' নামে একটি নতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠন করেন।
  3. সিলেট ও ময়মনসিংহ এলাকার হাজং আন্দোলনের সূত্রপাত হয় জমিদারীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই হাজংদের আন্দোলন আবার নতুন করে দানা বেঁধে ওঠে বানের ওপর সরকারী লেভী ও টঙ্ক (ধানের মাধ্যমে খাজনা) প্রথার বিরোধিতার মাধ্যমে। এটি সর্বশেষে সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ নেয় এবং হাজংদের পর ব্যাপক অত্যাঙ্গৱের ফলে এই আন্দোলনের বিলুপ্তি ঘটে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন কমিউনিষ্ট পার্টি সর্মথিত কৃষক সমিতি।