পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/২৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
২৩৪

উপর লাঠিচার্জ করা হয়। অনেকেই আহত হয়ে পড়ে রইলো রাস্তায় দু’পাশে। মিছিলটি মিটফোর্ড হয়ে চকবাজার দিকে মেডিক্যাল হোষ্টেলে গিয়ে শেষ হয়।

 অন্যদিকে সকাল ৯টায় জনসাধারণের এক বিরাট অংশ ‘মর্নিং নিউজ’ অফিস জ্বালিয়ে দেয় এবং ‘সংবাদ’ অফিসের দিকে যেতে থাকে। সংবাদ অফিসের সম্মুখে মিছিলের উপর মিলিটারী বেপরোয়া গুলী চালায়। অনেকেই হতাহত হয় এখানে।

 এইদিন জনসাধারণের বিভিন্ন অংশ শহরের বিভিন্ন অঞ্চলেও দলবদ্ধ হয়ে শোভাযাত্রা বের করে, আর ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। গ্রাম থেকে গাড়ীওয়ালা, মাঝি-মাল্লা, আর কৃষক-মজুর ছাত্র-শিক্ষকের এসে শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। এইদিন সমস্ত অফিস-আদালত, কারখানা, স্কুল-কলেজ, দোকান-পাট, যানবাহন বন্ধ করে তারা মিছিলে যোগ দিয়েছে। শহরের সকল প্রান্ত থেকে জনসাধারণ নিজেরাই মিছিল সংগঠিত করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের রেলওয়ে কারখানায় ধর্মঘট ঘোষিত হয়েছে। কারখানার শ্রমিকরাই রেলের চাকা বন্ধ করতে এগিয়ে এসেছে। প্রায় ১১টা পর্যন্ত রেল চলাচল একদম বন্ধ থাকে। সবদিক থেকে ব্যাপকতম ধর্মঘটের চাপে সরকার সেদিন বিকল হয়ে পড়েছিল। তারই চাপে পড়ে সেদিন পরিষদে লীগ সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার এবং তার জন্য গণপরিষদের কাছে সুপারিশ করার প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন গুলীচালনার প্রতিবাদে লীগ পার্লামেণ্টারী দল বর্জন করেন।

২৩শে ফেব্রুয়ারী

 গত দুই দিন ধরে পুলিশ-মিলিটারী নিরস্ত্র জনতার উপর বেপরোয়া গুলী চালিয়েছে। শহীদদের লাশগুলি নিয়ে পর্যন্ত সরকার ছিনিমিনি খেলেছে। লাশগুলি কোথায় নিয়ে গেছে তার কোন হদিসই মেলেনি। জনসাধারণের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে- তাদের মনের ক্ষত আরো দ্বিগুণতর হয়ে গেল। শহীদদের লাশ নিয়ে এ দুর্ব্যবস্থা দেখে ‘দৈনিক মিল্লাত’ সেদিন সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলল, “ইসলামী বিধান অনুসারে মুসলমানের লাশ অতি পবিত্র এবং অত্যন্ত তাজিমের সহিত দাফন কার্য সম্পন্ন করা বিধেয়। কিন্তু দুই দিনের পুলিশ জুলুমের ফলে শাহাদাতপ্রাপ্ত লাশগুলি ইহাদের অভিভাবকদের ফেরত দেওয়া হয় নাই। শরিয়ত মোতাবেক তাহাদের শেষকৃত্য যদি সমাপন না করা হইয়া থাকে তাহা হইলে সরকারকে গোনাহের ভাগী হইতে হইবে। ইসলামী রাষ্ট্র বলিয়া জাহির করার পরও পাকিস্তানে এইরূপ ঘটিতে দেওয়া অত্যন্ত আপত্তিকর। মুসলমান জনসাধারণের মনের ক্ষতে ইহার দ্বারা লবণের ছিটা দেওয়া হইয়াছে বলা যাইতে পারে।”

 সকাল বেলা সংবাদপত্রে দেখা গেল ৫ জন নিহত, ১৫০ জন আহত ও ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রদেশের সর্বত্র ঢাকার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সকল শ্রেণীর জনসাধারণের সংগঠিত বিক্ষোভ প্রদর্শিত হচ্ছে। ধর্মঘট-শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে সর্বত্র গণ-আন্দোলনের সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে জেলায় জেলায়। ঢাকায় পূর্ণ ধর্মঘট প্রতিপালিত হয়েছে এদিনও। নিরস্ত্র জনতার উপর নাজিরাবাজার ও রেল ষ্টেশনে লাঠিচার্জ করা হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেলের মাইকটি মিলিটারী এসে জোরপূর্বক দখল করে নিয়ে যায়। মেডিক্যাল হোষ্টেলের গেটের পাশেই ছাত্ররা নিজেরাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলে। শহীদ শফিউর রহমানের পিতা এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করেন। এইদিন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদকে আন্দোলন চালানোর জন্য আবার পূর্ণ কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। সভায় ৯ দফা দাবী স্থিরীকৃত হয় এবং নূরুল আমীনের জঘন্য মিথ্যা বিবৃতির প্রতিবাদে পাল্টা বিবৃতি দেওয়া হয় আর প্রদেশের ও কেন্দ্রের আন্দোলনে যোগসাধনের জন্য সক্রিয় কর্মপন্থা গ্রহণ করা হয়।