পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/২৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
২৬৭

 উর্দু ভাষাকে ইসলামী ভাবধারার অন্যতম বাহন বলা হয়ে থাকে; কিন্তু প্রশ্ন করতে পারি কি, এই উর্দু ভাষাতেই নিরীশ্বরবাদী কম্যুনিষ্ট কাব্য সাহিত্যের প্রচার সম্ভব হচ্ছে কি করে? উর্দু ভাষা যদি এতই সাফ-সুতরা ও পাক-পবিত্র হবে, তাহলে সে ভাষায় কম্যুনিষ্ট সাহিত্য রচনা করা হচ্ছে কেন? বস্তুতঃ বাংলা ইসলামী ভাবধারা প্রচারের অনুকূল ভাষা নয় বলে যাঁরা মতামত দেন, তাঁদের দৃষ্টিশক্তি নিতান্তই একপেশে। ইসলামী ভাবধারা তার নিজস্ব আদর্শের দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল। পৃথিবীর যে কোন ভাষায় যে কোন যুগে সার্থক রূপায়ণ চলতে পারে।

 বাংলাভাষার ইতিহাস আলোচনা করলে এ সত্য পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। বাংলাভাষার প্রাথমিক বিস্তারের মূলে ছিলেন মুসলমান, হিন্দুরা নয়। তৎকালীন বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবী-ফারসী শব্দের অস্তিত্ব ছিল। নবাব হোসেন শাহের আমলে প্রধানতঃ মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সংস্কৃত-ঘেঁষা রূপ অতি অল্পদিনের ঘটনা। বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা ভাষা থেকে আরবী ফারসী শব্দের প্রায় বিলোপ সাধন করেন এবং সংস্কৃত ব্যাকরণের উপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার রূপ দেন। বলা বাহুল্য, বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত সাধন-ঘেঁষা বাংলা আজ হিন্দুসমাজও ব্যবহার করেন না। ভাব ও সংস্কৃতির বিবর্তনের সাথে সাথে বাংলা ভাষায়ও বিবর্তন এসেছে- এই বিবর্তনের মুখে কাজী নজরুল ইসলামের আরবী-ফারসী মধুর আমেজ দেওয়া কাব্য ও ছন্দের রাজা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের আরবী-ফারসী শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগবিশিষ্ট কবিতা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা পূর্ববাংলার মুসলমানদের মনোজগতে এক বিরাট ভাববিপ্লবের সৃষ্টি করেছে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি যদি না করা হয় এবং উপর থেকে কোন কিছু চাপিয়ে দেবার কোন চেষ্টা যদি না হয়, তাহলে বাংলা ভাষা উর্দু ভাষা থেকেও তার আহরণী-প্রতিভার পরিচয় দেবে, নিঃসেন্দেহে এ আশা আমরা করতে পারি।

 আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবী করতে গিয়ে আমরা হীন প্রাদেশিকতার মনোভাবকে প্রশ্রয় দিচ্ছি না। আমরা বিশ্বাস করি, গোষ্ঠীগত ও দেশগত রূপ ছাড়াও প্রত্যেক মুসলমানের একটি বিশ্বজনীন রূপ আছে- প্রাদেশিকতার পঙ্কিলতায় নিমগ্ন হয়ে আমরা ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ দৃষ্টভংগীর পরিপোষকতা করার বিরোধী। সাথে সাথে একথাও বলে রাখা দরকার যে উর্দুকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে আমাদের কোন বক্তব্য নেই। বরং আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে ভাববিনিময়ের প্রয়োজনে আমাদের উর্দু শিখতে হবে। তাই অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর দাবীও আমরা সমর্থন করি।

 ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে একের বেশী দুইটি রাষ্ট্রভাষার অস্তিত্ব থাকলে জাতির ঐক্যে ফাটল ধরবে, কেউ কেউ এই অভিমতও পোষণ করে থাকেন। বলা বাহুল্য, এ যুক্তিও ইসলামের আলোকে মেনে নেওয়া চলে না। ঐক্য ঁ(হরুঃ) ও সমতা ঁ(হরভড়ৎসরুঃ) এক হবে, একই ভাষায় কাজ-কারবার করতে হবে, একই ধারায় চিন্তা করতে হবেথ-এ যুক্তি ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অচল। বৈচিত্র্যের মধ্যে মিলন- ইংরেজীতে যাকে বলা হয়, ঁহরুঃ রহ ফরাবৎংরুঃ-সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোই ইসলামের আদর্শ। একমাত্র সাধারণ আদর্শ ও জীবন-নীতির মাধ্যমেই একটি জাতিকে একতাসূত্রে আবদ্ধ করা যেতে পারে। পাকিস্তানের সংগ্রামে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বহু ভাষা-ভাষী মুসলমানের এগিয়ে এসেছিলেন। বাংলাদেশে লীগ ও পাকিস্তানের প্রচার চলেছিল বাংলা ভাষাতেই, মাদ্রাজে মাদ্রাজীতে, উড়িষ্যায় উড়িয়াতে। এতে পাকিস্তানের দাবী দূর্বল না হয়ে বরং জোরালোই হয়েছিল। পাকিস্তান সংগ্রামের অভাবিতপূর্ব সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল এই যে, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মুসলমানেরা আকৃতিগত, প্রকৃতিগত এবং ভাষাগত বিভেদ সত্ত্বেও একই আদর্শের পতাকাতলে সমবেত হতে পেরেছিলেন। আজ পাকিস্তান অর্জিত হওয়ার পর বাংলা-পাঞ্জাব-সিন্ধু-বেলুচিস্তান সীমান্ত প্রদেশের মুসলমানেরা যদি সমান প্রেরণা নিয়ে হুকুমাতে রববানিয়াৎ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের এগিয়ে আসেন, তাহলে ভাষার বিভিন্নতা, প্রাকৃতিক দূরত্ব এবং অন্যান্য অসুবিধা কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারবে না। তা ছাড়া আমরা বিশ্বাস করি আজকের যুগের ভাষার মাধ্যমে নয় বরং একমাত্র আদেশের মাধ্যমেই পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে দুনিয়ার বুকে বেঁচে থাকতে পারবে। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইরা যদি বাংলা শেখেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ