পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৪০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৩৭৯

প্রত্যহ ৪২ টাকা হিসাবে ভাতা দেওয়া হইয়াছে। এই বিপুল অর্থ যে দরিদ্র জনসাধারণই দিয়াছে, একথা বলাই বাহুল্য।

ব্যক্তিস্বাধীনতা বিপনণ

 পাকিস্তানের নিজস্ব শাসনতন্ত্র না থাকয় এই রাষ্ট্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা বিপন্ন হইয়াছে। সারা পাকিস্তানে দেড় হাজারের অধিক অধ্যাপক, উকিল, ছাত্র-ছাত্রী ও দেশপ্রমিক যুবকগণ জেলের মধ্যে বিনা বিচারে আটক ছিল, অথচ ইসলামের বিধান অনুসারে বিনা বিচারে কাহাকেও আটক রাখা যায় না। বন্দীদিগের প্রতি জেলে যে ব্যবহার করা হয়, তাহা মনুষ্যোচিত বলা যায় না। প্রথম শ্রেণীর রাজবন্দীদের জন্যে দৈনিক ১ টাকা ২ আনা ৫ পয়সা খাদ্যের বরাদ্দ করা আছে, কিন্তু মুসলীম লীগের পোষা কণ্ট্রাকটরদের চুরি করার পর বন্দীদের ভাগ্যে ৮ আনা হইতে ১০ আনার অধিক খাদ্য জোটে না।

খুনীর ভূমিকায় মুসলিম লীগ

 জার্মানীতে হিটলারের আমলে সামান্য কারণে বন্দীদিগকে যেভাবে হত্যা করা হইত, মুসলিম লীগ শাসনে পাকিস্তানে তাহা হুবহু অনুসৃত হইতেছে। ইহার ফলে বহু মেধাবী ছাত্র লীগ-শাহীর অত্যাচারে জ্ঞান দিয়াছে। রাজশাহী জেলে যে গুলীবর্ষণ করা হইয়াছিল, তাহাতে কয়েকজন হতাহত হয়। নিহতের মধ্যে ছিল খুলনা জেলার এক দরিদ্র বিধবার একমাত্র পুত্র আনোয়ার, সে দ্বিতীয় বার্ষিক বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিল।

 ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের সময় নূরুল আমীন সরকার গুলী করিয়া কয়েকজন নওজোয়ানের জীবনলীলার অবসান করে। নিহত ব্যক্তিদের দাফন পর্যন্ত ইসলামী কানুন মত করা হয় নাই। তদানীন্তন মুসললিম লীগের মুখপত্র দৈনিক মিল্লাত (২৩ ফেব্রুয়ারী) ১৯৫২ সন এ সম্পর্কে পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করিয়াছিলেন।

 ঢাকার লালবাগের পুলিশ ব্যারাকে নূরুল আমীন সরকার গুলী চালাইয়া প্রায় তিনশত পুলিশকে হতাহত করেন বলিয়া প্রকাশ। ইহাদের কি দোষ ছিল, তাহা সরকার বলেন নাই। এবং গুলী চালনার ব্যাপারও বহুদিন গোপন রাখা হইয়াছে।

মুসলিমর লীগের অন্যতম অপকীর্তি করাচীতে ছাত্রদের উপর গুলী চালানো। ছাত্রদের অপরাধ ছিল যে তাহারা বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদ শোভাযাত্রা বাহির করিয়াছিল। এই সামান্য কারনে ১২ জন ছাত্রকে যে মুসলিম লীগ সরকার গুলী করিয়া মারিতে পারে, দেশ শাসনের কোন অধিকার তাহাদের থাকা উচিত নয়।

 চট্টগ্রামে বাঁধ কাটা লইয়া গুলীবর্ষণ ও নবীনগরে মসজিদের মধ্যে গুলীবর্ষণ লীগ-শাহীর অন্যতম অপকীর্তি হইয়া রহিল। সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে আহমাদীয়া বিরোধী আন্দোলনের সময় সামরিক আইন জারী করিয়াও বহুসংখ্যক লোককে লীগ সরকার খুন করিয়াছে। বহুসংক্যক সম্মানিত উলামায়ে কেরামকে উলঙ্গ করিয়া বীভৎসভাবে প্রহার করিবার ইতিহাস লোকে মুখে মুখে প্রচারিত।

 মুসলিম লীগ সরকার জনগণের প্রয়োজন মিটাইতে পারে নাই, ফলে তাহাদের দাবী-দাওয়ার সম্পূর্ণ আইনসম্মত সংগ্রাম শক্তির দ্বারা দাবাইয়া রাখার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশী ব্যয় অসম্ভব রকম বৃদ্ধি করিয়াছে। যুক্ত বাংলার আমলে বাংলাদেশে একজন আই.জি. পুলিশের অধীনে মাত্র ৬ জন সহকারী আই, জি, থাকিতেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান সমগ্র বাংলার আয়তন অপেক্ষা অনেক কম হইলেও এখানে একজন আই,জি থাকিতেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান সমগ্র বাংলার আয়তন অপেক্ষা অনেক কম হইলেও এখানে আইজি, পুলিশের অধীনে কমপক্ষে ১১ জন ডি, আই, জি, বহাল করা হইয়াছে। অথচ অপরাধের সংখ্যা ছিল ৫৪৫৬৬, কিন্তু ১৯৫০ সালে এই অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি হইয়া দাঁড়ায় ২১৮৬৭০। এই হিসাব হইতেই প্রমাণিত হইতেছে যে, মুসলিম লীগ দেশ শাসনের নামে অরাজকতার সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে। পুলিশ বিভাগকে ব্যয়বহুল করা সত্ত্বেও যখন অপরাধের সংখ্যা কমে নাই তখন বুঝিতে হইবে যে পুলিশ বিভাগে সচ্চরিত্র ও উপযুক্ত লোকদিগকে স্থান দেওয়া হয় নাই।