পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৪১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৩৯২

অর্থাভাবে এই সকল আবশ্যকীয় কাজ করিতে পারিতেছেন না। এই অর্থাভাবের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচীন পুঁথির সংস্করণ ছাপাইতে পরিতেছেন না।

 ······সুতরাং এখন আমাদের একমাত্র ভরসা যে প্রস্তাবিত বাংলা সাহিত্য নিকেতন পূর্ববঙ্গ সরকার কর্তৃক স্থাপিত হইয়া এই সমস্ত সাহিত্যিক অভাব দূর করিতে অগ্রসর হইবে।”

 আমি সর্বপ্রথম ১৯৪৮ সালের সাহিত্য সম্মেলনে এই একাডেমী কথা বলেছিলুম। “আমাদিগকে একটি একাডেমী (পরিষদ) গড়তে হইবে, যার কর্ত্তব্য হবে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য বিষয়ে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাবলীর অনুবাদ বাংলায় প্রকাশ। এজন্য এক পরিভাষা সমিতি প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে আরবী, পারসী এবং উর্দু ভাষা থেকে পাকিস্তানের ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে বইগুলির অনুবাদ একান্ত প্রয়োজনীয়।”

 প্যারিসে অপধফবসরব ঋৎধহপধরংব-এর নিয়ন্ত্রনাধীনে ফরাসী অভিধান সংকলন করা হয়েছে, তাতে যেসব শব্দ আছে তাছাড়া ফরাসী সাহিত্যে অন্য শব্দ ব্যবহার করবার কারো অধিকার নেই। আমাদের এই সাহিত্য নিকেতনেরও কাজ হবে এইরূপ একটি অভিধান সংকলন করা। কিন্তু দক্ষ কর্ণধার না হলে নৌকা যেমন মাঝ দরিয়ায় ডুবে যায় সেইরূপ এই সাহিত্য নিকেতনের যদি উপযুক্ত অধ্যক্ষ নিযুক্ত না হয় তবে তাঁর দ্বারা ইষ্ট অপেক্ষা অনিষ্ঠ হবারই আশঙ্কা বেশী আছে। আশা করি আমাদের জনপ্রিয় সরকার বিশেষতঃ শিক্ষামন্ত্রী আমাদের এই মন্তব্যটি ধীরভাবে বিবেচনা করে দেখবেন।

 ভূতপূর্ব লীগ সরকারের আমলে বাংলা ভাষা ও অক্ষর সম্বন্ধে যে কৃত্রিম সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছিল দুঃখের বিষয় এখনও পর্যন্ত কেউ কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, এই প্রসঙ্গে আমি ১৯৪৮ সালে ঢাকায় সাহিত্য সম্মেলনে যা বলেছিলুম এখানে তা উদ্ধৃত করার প্রয়োজন মনে করছি।

 “মূল আর্য্যভাষার সঙ্গে মিশেছে আদি যুগে কোল, মধ্যযুগে ফারসী ও পারসীর ভিতর দিয়ে কিছু আরবী ও যৎসামান্য তুর্কি এবং পরবর্তী যুগে পর্ত্তুগীজ আর ইংরেজী। দুচারটা দ্রাবিড়, মোঙ্গলী, ফরাসী, ওলন্দাজ প্রভৃতি ভাষার শব্দও বাংলায় আছে। মিশ্র ভাষা বলে আমাদের কিছু লজ্জা নেই। পৃথিবীর সর্ব্বাপেক্ষা চলিত ভাষা ইংরেজির প্রায় দশ আনা শব্দসমষ্টি বিদেশী। পশ্চিম বাংলার পরিভাষা নির্ম্মাণ সমিতি খাঁটি সংস্কৃত ভাষায় পরিভাষা রচনা করেছেন। পাঠ্য পুস্তকে এইরূপ খাটি আর্য্য ভাষা চলতে পারে কিন্তু ভাষায় চলে না। আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষার ক্ষেত্রে গোড়ামি বা ছুঁৎমার্গের কোনও স্থান নেই।”

 “ঘৃণা ঘৃণাকে জন্ম দেয়। গোঁড়ামি গোঁড়ামিকে জন্ম দেয়। একদল যেমন বাংলাকে সংস্কৃত-ঘেঁষা করতে চেয়েছে, তেমনি আর একদল বাংলাকে আরবী- পারসী ঘেঁষা করতে উদ্যত হয়েছে। একদল চাচ্ছে খাঁটি বাংলাকে বলি দিতে, আর এক দল চাচ্ছে ‘জবে’ করতে। একদিকে কামারের খাঁড়া, আর একদিকে কসাইয়ের ছুরি।”

 “নদীর গতিপথ যেমন নির্দ্দেশ করে দেওয়া যায় না, ভাষারও তেমনি। একমাত্র কালই ভাষার গতি নির্দ্দিষ্ট করে। ভাষার রীতি (style) ও গতি কোন নির্দ্দিষ্ট ধরা-বাঁধা নিয়মের অধীন হতে পারে না। ফরাসী ভাষায় বলে Le style c’est I’ homme- ভাষার রীতি সেটা মানুষ-অর্থাৎ মানুষে যেমন তফাৎ, প্রত্যেক লোকের রচনাতেও তেমনি তফাৎ থাকা স্বাভাবিক। এই পার্থক্য নির্ভর করে লেখকের শিক্ষা-দীক্ষা, বংশ এবং পরিবেষ্টনীর উপর। মোট কথা ভাষা হওয়া চাই সহজ, সরল এবং ভাষার রীতি (style) হওয়া চাই স্বতঃস্ফূর্ত, সুন্দর ও মধুর। আমাদের স্মরণ রাখা উচিত ভাষা ভাব প্রকাশের জন্য, ভাব গোপনের জন্য নয়, আর সাহিত্যের প্রাণ সৌন্দর্য, গোঁড়ামি নয়।