পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৪৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৪৪৫

গ্রন্থের রচয়িতা বলিয়া উইলিয়াম কেরীর খ্যাতির কথা সর্বজনবিদিত। আমি মোটামুটিভাবে এই সত্যটির কথা বলিতেছি যে, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের দানে এই ভাষা গড়িয়া উঠিয়াছে এবং বর্তমানকালে ইহার খ্যাতি দুনিয়ার সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছে। আজা বাংলা একাডেমীর উদ্বোধন দিবসে আমি তাই সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলকেই ইহাকে আরও সমৃদ্ধ করিয়া তুলিতে আহ্বান জানাইতেছি।

বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্য্যাদা

 আমরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করিতে সঙ্কল্প করিয়াছি তাহা আমরা করিবই। ইহাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আমি আমাদের প্রিয় নেতা জনাব ফজলুল হক সাহেবের কথাতেই বলিব যে, যে-শাসনতন্ত্রে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হইবে না, তাহা আমরা কিছুতেই গ্রহণ করিব না। তাই এখন সেই মর্যাদা দানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কতকগুলি কর্তব্য ও দায়িত্বের দিকেও দৃষ্টি দিতে হইবে।

ভাষার সমৃদ্ধি-সাধন

 বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ ও পরিণত করিতে হইবে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মর্যাদা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে সন্দেহ নাই কিন্তু পূর্ব হইতে এই ভাষা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করিলে যত উন্নত হইত, তাহা হইতে পারে নাই। আমদের পরিভাষা প্রণয়ন, অভিধান প্রণয়ন, ব্যাকরণ-গবেষণা, বর্ণমালার উন্নতি বিধান, মুদ্রণ কার্যকে সহজতর করা সাহিত্যকে উন্নত ও সমৃদ্ধতর করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি প্রভৃতি বহু কর্তব্য বাকী আছে। যে সব প্রবাদ ব্যক্তিগত জীবনের দর্শন হিসাবে মুখে মুখে হাটে-মাটে-ঘাটে ছড়াইয়া আছে তাহার মধ্যে দেশ সংস্কৃতির ও চারিত্রের যে রূপ তাহা উদ্ধার করিবার দায়িত্বও উপেক্ষণীয় নয়। আমি আশা করি এই বাংলা একাডেমী এই অভাব পূরণ করিবে।

পূর্ববঙ্গের ভাষার স্বাতন্ত্র্য

 তাহা ছাড়া পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষার একটি স্বাতন্ত্র্য আছে। রংপুর হইতে চট্টগ্রামে, যশোহর হইতে সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত এই অঞ্চলে নানারকম কথ্য ভাষা আছে। কিন্তু সারা পূর্ব বাংলায় কোন ষ্ট্যাণ্ডার্ড বা সাধারণ কথ্যভাষা এখনও গড়িয়া উঠে নাই। ইহা সম্ভব কি না, তাহা ভাষাতত্ত্ববিদরাই বলিবেন। যদি সম্ভব হয়, তাহা হইলে এই ব্যাপারেও বাংলা একাডেমীর বিশেষ দায়িত্ব আছে বলিয়া আমার বিশ্বাস। আমি স্বীকার করি, যে-কোন ষ্টাণ্ডার্ড ভাষা উপর হইতে চাপাইয়া দেওয়া যায় না। ভাষা আপনা হইতে উৎপত্তি লাভ করে, কিন্তু একেবারে আপনা আপনিই উৎপত্তি লাভ করে- তাহা আমি স্বীকার করি না। সব কিছুর মত ভাষার রূপ রূপান্তর, গতিধারাও পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। জনগণের প্রয়োজনের দিক হইতে আমাদের ভাষার একটা ষ্ট্যাণ্ডার্ড রূপ গ্রহণের অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টির ব্যাপারে বাংলা একাডেমী অনেক কিছু করিতে পারে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের যাহা কিছু এখনও অবশিষ্ট রহিয়াছে, তাহা দূর করিয়া একটা শোষণমুক্ত সমাজ গড়িয়া তুলিবার জন্য আমরা কাজ করিয়া যাইতেছি; আমাদের ভাষা ও সাহিত্যক তাহার আনুকূল্য করিতে হইবে। সুতরাং বাহির হইতে প্রয়োজন অনুসারে আহরণ করিয়া এই ভাষা সমৃদ্ধতর করিলেও আমাদের বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তাকে আমরা কিছুতেই নষ্ট হইতে দিব না।

 আমাদের জাতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সার্থক বাহন হিসাবে এই ভাষা ও সাহিত্য জগৎ সভায় মর্যাদার আসন পাইবে।

সাহিত্যের প্রচার ও প্রসার-সাধন

 আমার কর্মব্যস্ততার মধ্যেও আমি আমাদের কবি সাহিত্যিকদের লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ কিছু কিছু পড়িয়া থাকি। ইহার ভিতর বহু মূল্যবান রচনাও আমার চোখে পড়িয়াছে। কিন্তু বাহিরের দুনিয়ার এইগুলি উপযুক্ত আদর পাইতেছে না। এমনকি দেশের ভিতরেও অনেক সময় এইগুলি ব্যাপক প্রকাশ ও প্রচারের সুযোগ