পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৬২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
৬০১

 আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গবেষণা করা অবশ্য আমাদের কাজ নয়, এই ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য শুধু এইটুকু যে, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যাঁরা পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি বদলাইতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাঁরা পাকিস্তানকে কোথায় লইয়া যাইতে চান? পররাষ্ট্রনীতিতে নিরপেক্ষতা মানে বন্ধুহীনতা, শুধু তাই নয়, জনাব সোহরাওয়ার্দীর ভাষায় ‘ব্ল্যাকমেলিং। এই বাদুড়নীতি আজ ভারতকে বন্ধুহীন করিয়াছে, কাশ্মীর প্রশ্নের আজ একজনও তার সমর্থক নাই। এসব দেখিবার পরও তারা পাকিস্তানকে ভারতের অনুসরণ করিতে বলিতেছেন কোন সদুদ্দেশ্যে? কাশ্মীর সমস্যার সুসমাধান যতদিন না হইতেছে, ততদিন প্রতিবেশী হইলেও, ভারতকে পাকিস্তান বন্ধুরাষ্ট্র বলিয়া স্বীকৃতি দিতে পারে না। কাজেই এই সময় পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভারতের বাদুড়নীতির অনুকরণ করিতে যারা বলেন, পাকিস্তানের মঙ্গল তাদের কতটুকু কাম্য?

 তাছাড়া মওলানা ভাসানীর ভাষণে এমন কতকগুলি উক্তি আছে, যাতে সত্যভাবে পাকিস্তানী মাত্রই শঙ্কিত হইয়া পারেন না। মোছলেম লীগের নিন্দায় মওলানা ভাসানী তার ভাষণে একেবারে পঞ্চমুখ হইয়া উঠিয়াছেন। তা হোন, কিন্তু বেসামল হইয়া তিনি এমন কথাও বলিয়া ফেলিয়াছেনঃ “প্রাক- স্বাধীনতা যুগেরও মোছলেম লীগের কোন অস্তিবাচক জীবনদর্শন ছিল না। প্রধানতঃ বিদ্বেষকে অবলম্বন করে সেদিন আমাদের রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে। জীঘাংসার নিবৃত্তি হলে আমরা কি গড়ে তুলব সেদিন একথা আমাদের কোন নেতা চিন্তা করেননি এবং চিন্তা করেননি বলেই পাকিস্তানে আজ পর্যন্ত সত্যকার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হল না।”

 উপরোক্ত উক্তির সোজা অর্থ এই দাঁড়ায় যে কায়েদে আজমের নেতৃত্বে যে পাকিস্তান আন্দোলন পরিচালিত হইয়াছিল তাহা ছিল নিতান্তই নেতিবাচক হট্টগোল মাত্র, জীবনদর্শন বলিয়া কেন গঠনমুলক ব্যাপার তাতে ছিল, আর বিয়ে ছিল এই হট্টগোলের ভিত্তি। এবং মার-কাটের ভিতর দিয়া পাকিস্তান আসিয়াছে বলিয়াই পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইল না।

 পাকিস্তান আন্দোলন এবং সে আন্দোলনের নেতা কায়েদে আজম সম্পর্কে ভারতীয় কংগ্রেসীরা অনেক কুকথা বলিয়াছেন বটে কিন্তু এমন কথা তারাও বলিতে পারেন নাই। কায়েদে আজমের মোছলেম আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবী, মওলানা ভাসানীর মতে ছিল নেতিবাচক কথামাত্র। কায়েদের আজম চাহিয়াছিলেন বড়- ছোটর ভেদাভেদ ঘুচাইয়া শোষণহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করিতে। তাঁর এ উক্তিও তাহা হইলে জীবনদর্শনহীন বাজে কথামাত্র। বস্তুতঃ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা সম্পর্কে এমন প্রশস্তি (!) আর কোন দেশে কখনো উচ্চারিত হইয়াছে কিনা সন্দেহ। পাকিস্তানের উৎপত্তি সম্পর্কে এমন ন্যক্কারজনক ঘৃণ্য উক্তি শুনিবার দুর্ভাগ্য আমাদের হইবে এরূপ কল্পনাও আমাদের ছিল না। পাকিস্তান সম্পর্কে এই ধারণা পোষণ করেন বলিয়াই কি মওলানা ভাসানী ইহাকে আজ রসাতলে লইয়া যাইবার মতলব আঁটিয়াছেন?

 তাঁর এই মতলব ধরা পড়িয়াছে তাঁর আর একটি উত্তিতে। তিনি বলিয়াছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ যদি বন্ধ না হয় তবে অদূর ভবিষ্যতে এমন দিন আসিবে, যখন পূর্ব পাকিস্তান হয়ত পশ্চিম পাকিস্তানকে জানাইবে ‘আসসালামো আলায়কুম। অর্থাৎ পাকিস্তান হইতে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে। পাকিস্তান সম্পর্কে কোন পাকিস্তানীর মুখে পাকিস্তান বিচ্ছেদের মারাত্মক কথা যে এমন হালকাভাবে উচ্চারিত হইতে পারে, ইহা কে কবে ভাবিতে পারিয়াছিল? এমন কথা মুখে উচ্চারণ করিতে পারেন মাত্র তাঁরাই, যাঁরা পাকিস্তানের সংহতির কোন গুরুত্বই উপলব্ধি করিতে পারেন না। পাকিস্তানের উভয় অংশ যদি খোদা না করুন, পৃথক হইয়া পড়ে, তাহা হইলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব থাকিবে কি? আর থাকিলেও বিশ্ব রাজনীতিতে তার কোন গুরুত্ব থাকিবে কি? পশ্চিম পাকিস্তান-বিদ্বেষে এমন কথা কোন পাকিস্তানী উচ্চারণ করিলে তাতে তার পূর্ব পাকিস্তান নীতি হয়ত প্রকাশ পাইতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের প্রতি ইহা রাষ্ট্রদ্রোহকর উক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া মওলানা ভাসানীর দলই যখন বর্তমানে রাষ্ট্রতরণীর কর্ণধার তখন এমন উক্তির মাত্র একটি অর্থই হইতে পারে, এবং তা হইতেছেঃ যিনি এমন উক্তি করেন, পাকিস্তান হিসাবে এই রাষ্ট্রের টিকিয়া থাকা তাঁর কাম্য নয়।