এইসব পণ্ডিতদের বিজ্ঞোচিত তত্ত্বের এই ভয়াবহ পরিণতি ও যুক্তি অসারতা আজ জনসাধারণের নিকট ধরা পরিয়াছে। সুতরাং জাতি বাদ দিয়া হিন্দুদিগকে সংখ্যালঘু প্রভৃতি আখ্যা দিয়া নিজেদের মুখ বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছেন এবং এই সকল সংখ্যালঘুকে রক্ষাকবচ দেওয়ার নামে পৃথক নির্বাচনের ওকালতি করিতেছেন। সংখ্যালঘুদের অবশ্যই রক্ষাকবচ দিতে হইবে, ইহা পৃথিবীর সর্বত্রই স্বীকৃত হইয়াছে। একটি রাষ্ট্রে এমন কয়েকটি গোষ্ঠী থাকিতে পারে, যাহারা বিভিন্ন কারণে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিকাশের সুযোগ হইতে বঞ্চিত হইয়া রাষ্ট্রের উন্নত নাগরিক হিসাবে নিজেদের গড়িয়া তোলার সুযোগ পায় নাই। এই ক্ষেত্রে তাহাদের ঐ সমস্ত সুযোগদানের জন্য রাষ্ট্রীয় গঠনতন্ত্রে তদুপযোগী বিধান সন্নিবেশিত করিয়া মনগড়া বিকাশের ব্যবস্থা করিতে হইবে। এই রক্ষাকবচদিতে হইবে, ইহা যেমন হাস্যোদ্দীপক, তেমনি কৌতুকপূর্ণ। অন্যদিকে রক্ষাকবচ অর্থ পৃথক নির্বাচনে, এই উদ্ভট যুক্তি তাহারা কোথায় খুঁজিয়া পাইয়াছেন, তাহা তাহারাই বলিতে পারেন। যাহাদিগকে একবার “জাতি” বলা হইতেছে, মুখের এক কথায় আবার তাহাদিগকে “সংখ্যালঘু” বানান হইতেছে। ইহার কারণ “জাতি” “সংখ্যালঘু” রক্ষাকবচ” ও “পৃথক নির্বাচন” প্রভৃতি সামঞ্জস্যহীন যুক্তির অবতারণা করিয়া নিজেদের মুখ বাচাঁনোর ছাড়াতাদের আর গত্যন্তর নাই।
সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপত্তা রক্ষাকবচ ব্যবস্থাকে সংখ্যালঘুদের মতামত নিয়াই কায়েক করা উটিত এবং কি ধরনের রক্ষাকবচদরকার, তাহাও তাদের মতামতের উপর নির্ভর করিতে হইতে। সংখ্যালঘুদের রক্ষাকবচ তাদের মতের বিরুদ্ধে চাপাইয়া দেওয়া যুক্তিসঙ্গত নহে। পাকিস্তানে এই “সংখ্যালঘুরা” তাদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের মারফতে যুক্ত নির্বাচনে স্বপক্ষে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করিয়াছেন। তবুও তাহাদিকে পৃথক নির্বাচনের রক্ষাকবচ নিতেই হইবে” এই মনোভাব পরিহার করা উচিত।
কায়েমী স্বার্থের সাম্প্রদায়িতকা বিদ্বেষকে কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয় নাই, ইহার বিষক্রিয়াকে সমাজ জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চালানো হইয়াছে। এই সেইদিনও পাঞ্জাবের কাদিয়ানী-আহরার পৈশাচিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হইয়াছে। পাঞ্জাবী-বাঙ্গালী বিদ্বেষ আদমজী পাটকলের দাঙ্গায় নিরীহ শ্রমিকদের রক্ত বহিয়াছে। শিয়াদের ইমামতিতে সুন্নীরা নামাজ পড়িতে রাজী নহে। খোঁজ করিলে যেখানে বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যেই সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হইয়াছে, সেখানে এই “পৃথক নির্বাচনের রক্ষাকবচের” ব্যবস্থা কোথায় গিয়া শেষ হইবে তাহা চিন্তা করিয়া দেখা দরকার। এই পৃথক নির্বাচনের রক্ষাকবচ পরিণামের এমন অবস্থার সৃষ্টি করিবে যে অদূরভবিষৎতে নিজের দেওয়া ছাড়া অন্যকে ভোট দেওয়ার আর উপায় থাকিবে না।
সাম্প্রদায়িকতার সীমা নাই। এই বিষেষ বর্তমান সমাজব্যবস্থারই একটি অভিশাপ, সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে তাগিদে এই সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হয় নাই। ইহা কতিপয় মানুষের স্বার্থের জন্য সৃষ্টি করা হইয়াছে। তাই পৃথক নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের প্রয়োজনে না লাগিলেও তাহাদের রক্ষাকবচের নামে তাহাদের উপর চাপাইয়া দেওয়ার এত আড়ম্বর।
এই রক্ষাকবচ দেওয়ার কথা তুলিয়া সংখ্যালঘুদের রক্ষাকবচের নামে পৃথক নির্বাচনের দাবীকে খর্ব করার চেষ্টা করা হইয়াছে বলিলে ভুল করা হইবে। অতীতে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভিতর দিয়া হিন্দু মুসলমানদের ভিতর বিভেদের “বাস্তবতার” জিগীর তুলিয়া যাহারা পৃথক নির্বাচনের যৌক্তিকতা দাঁড় করাইয়াছেন, তাহাদের মনে রাখা উচিত যে, মুসলমানে মুসলমানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তাহাদের চাইতেও মর্মান্তিক রক্ত ক্ষয় হইয়াছে। সাম্প্রদায়িকতা মানুষের ভিতরে একটি বিদ্বেষভাব ছাড়া আর কিছুই নহে।
ইহার অবসান, এই সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিয়া হইতে পারে না। ইহার অবসান হইতে পারে মানুষের মহা মিলনের পথে।