পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৭৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৭৫৫

রাসুলুল্লাহ আবির্ভাব না ঘটিলে সেখানকার ইতিহাস হয়তো মানব ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায় হইয়া থাকিত।

 আরবের নিপীড়িত মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠা আজও সম্ভবপর হয় নাই, সত্য কথা, কিন্তু রসুলুল্লাহ প্রদর্শিত মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামও তাদের থামে নাই। দেশী ও বিদেশী জালেমদের সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে জাজিরাতুল আরবের মজলুম জনসাধারণ সংগ্রাম করিতেছে। তাদের পশ্চাতে আছে সারা পৃথিবীর মজলুম জনসাধারণের শুভেচ্ছা ও নৈতিক সমর্থন।

বন্ধুগণ!

 পাক-ভারতের আজাদীর সংগ্রামের ইতিহাস অন্য দেশের সংগ্রামের ইতিহাস হইতে ভিন্ন নয়। যেদিন হইতে বিদেশী শক্তি ভারতে তাদের রাজত্ব কায়েম করে সেদিন হইতেই সেই বিদেশী শক্তির নির্যাতনের যূপকাষ্ঠে প্রাণ দিল ভারতের মুসলমান। প্রাণ দিল ভারতের হিন্দু, বৌদ্ধ সকলে সমানভাবে। সিপাহী বিদ্রোহ স্বাধীনতাকামী জনসাধারনের এক ঐতিহাসিক জাগৃতি, এক গৌরবোজ্জ্বল স্বাক্ষর।

 দিল্লীর শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ বার্মায় নির্বাসিত হইলেন। আর তাঁর সঙ্গে প্রাণ দিলেন ঝান্সির রানী, অযোধ্যার বেগম, তাঁতিয়াটোপী, নানা সাহেব, মাওলানা আহমদুল্লাহ এবং আরও লক্ষ লক্ষ নাম না জানা মুসলমান ও হিন্দু।

 পলাশীর প্রান্তরে সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে জীবন দান করেন মীর মদন মোহন লাল। সেদিন বাংলার স্বাধীনতাকামীদের প্রথম এবং মহান পরীক্ষা। কিন্তু কতিপয় দেশদ্রোহীর চক্রান্তে আমাদের স্বাধীনতার রবি অস্তমিত হইল। যাহারা বিশ্বাসঘাতক, যাহারা দেশদ্রোহী তাহাদের কোন ধর্মীয় পরিচয় নাই। তাই অতীতের সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে বিদেশী শক্তির চক্রান্তে যোগ দেয় মুসলমান মীর জাফর, আগাইয়া আসে হিন্দু উমি চাঁদ, রাজবল্লভ। স্বাধীনতা রক্ষার শপথ নিয়া একদিকে অগ্রসর হইলেন সিরাজ, মোহন লাল ও মীর মদন। অপরদিকে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের জন্য দেশের স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইলেন বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ। বিশ্বাসঘাতকরাই সেদিন জয়লাভ করিল। বিদেশী শক্তির সাহায্যে দেশদ্রোহীরাই প্রমাণিত হইল অধিকতর শক্তিশালী।

 সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আমাদের দেশে আবারও কি ঘটিবে?

 বন্ধুগণ! পলাশী যুদ্ধের পর হইতে বৃটিশ সরকার একটি নতুন দেশীয় শোষক শ্রেণী সৃষ্টি করিতে লাগিলেন। এই শোষকের দলে মুসলমান ছিল নগণ্য; কারণ মেকিয়াভেলির নীতি অনুসারে ইংরাজ পরাজিত মুসলমান সমাজের শিক্ষিত ও সমৃদ্ধিশালী লোকদিগকে পাইকারীভাবে হত্যা করিয়াছিল। মোট কথা ইংরেজ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য চিরাচরিত পথ অবলম্বন করিল।

 কিন্তু বিরোধের মধ্যেও ঐক্যের সুর ছিল। সে ঐক্য ধ্বনি শুনাইয়া দিয়া গিয়াছে ওহাবী আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহ। সে ঐক্যের পতাকা উর্ধে তুলিয়া ধরিয়াছে খেলাফত আন্দোলন। বিদেশী শক্তির সঙ্গে সঙ্গে মীর জাফর, উমিচাঁদের ন্যায় ভারতের গণদুশমন প্রতিক্রিয়াশীল চক্রও জনসাধারণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে আতংকিত হইয়া উঠে। কিন্তু তাহাতে আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন থামিয়া যায় নাই। স্বাধীনতার প্রেরণা ও আদর্শ নিয়াই আমরা আমাদের স্বাধীন আভাসভূমি পাকিস্তান অর্জনের সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ি। ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্ব মজলুম মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের স্বীকৃতি দিতে রাজী হয় নাই। তাই আমরা কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াছি। কিন্তু আমাদের সে সংগ্রামের মূল কথা ছিল সর্বপ্রকার অত্যাচারের অবসন ঘটাইয়া বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবমুক্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন করা। স্বাধীন ও সার্বভৌম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আদশেই সেদিন ভারতের কোটি কোটি মুসলমান উদ্বুদ্ধ হইয়াছিল।