পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৭৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৭৬৩

 আমরা মনে করি যে, এই চুক্তির ফলে আমাদের দেশও বিশ্বযুদ্ধ চক্রান্তে জড়াইয়া পড়িবে, আমাদের দেশের ধনসম্পদ ও জনবল আমেরিকার যুদ্ধ ষড়যন্ত্রে ব্যবহৃত হইবে এবং আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হইবে।

 এই বিবৃতিতে বহু আওয়ামী লীগ নেতা যথা পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খান, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান শিল্প ও শ্রমমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, কেন্দ্রের বর্তমান শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব আবুল মনসুর আহম্মদ প্রমুখ নিজ হাতে স্বাক্ষর দিয়াছিলেন।

 যাহা হোক, আমি ইহাই বলিতেছি যে, বৃটেন ও আমেরিকার শাসকবর্গের নীতি ও কার্যকলাপ, বিভিন্ন দেশে আমেরিকার ডলার সাহায্যের ফলাফল এবং সামরিক চুক্তিগুলির শর্তাবলী বিচার বিবেচনা করিয়াই আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করিয়াছিল যে, ঐ চুক্তিগুলো “দেশের রাজনৈতিক ও স্বাধীনতার পরিপন্থী” এবং আওয়ামী লীগ “সকল প্রকার সামরিক চুক্তির বিরোধিতা করে”।

 কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় যে, জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী সমস্ত জানিয়া শুনিয়াও, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুকাল পর হইতে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের সহিত মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক অনুষ্ঠিত সামরিক চুক্তিগুলিকে প্রকাশ্যে সমর্থন করিতে থাকেন। এই কাজ দ্বারা তিনি যেমন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানের নীতি ও আদর্শগত শৃঙ্খলা ভঙ্গ করিয়াছেন, তেমনি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নকে ভুলিয়া গিয়াছেন।

 আমি এবং আওয়ামী লীগের বহু কর্মী প্রথম হইতে জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঐ কাজের তীব্র প্রতিবাদ জানাইয়াছি। আমরা আশা করিয়াছিলাম, জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজের ভুল বুঝিতে পারিবেন। সেজন্য তাঁহাকে আমরা সময়ও দিয়াছিলাম। কিন্তু কিছুতেই কোন ফল হয় নাই। তিনি নিজ ইচ্ছা অনুসারে সাম্রাজ্যবাদীদের সহিত সহযোগিতা করিয়া চলিয়াছেন।

কাশ্মীর ও খালের পানি:

 মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক অনুষ্ঠিত সামরিক চুক্তিগুলি সমর্থনে জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি প্রধান যুক্তি প্রদর্শন করিতেছেন যে, ইহাতে আমাদের কাশ্মীর লাভ করার পক্ষে সহায়তা হইতেছে। কাশ্মীরে অবোধ গণভোট অনুষ্ঠিত হউক এবং কাশ্মীর পাকিস্তানে আসুক ইহা আমাদের সকলের অকুণ্ঠ দাবী। ভারত সরকারের বাধা এবং একগুয়েমিপূর্ণ নীতি সত্ত্বেও কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান ও আমাদের ঐ দাবী হাসিল করার জন্য যথাযোগ্য পথও আমাদের গ্রহণ করিতে হইবে।

 বাস্তবে দেখা যাইতেছে যে; মুসলিম লীগ সরকার প্রথমবধি বৃটেন আমেরিকার উপর নির্ভর করিয়া ও পরে সামরিক চুক্তিগুলিতে যোগ দিয়া কাশ্মীরকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রচেষ্টা সুদীর্ঘকাল যাবৎ চালাইয়া আসিয়াছিলেন, তাহা ব্যর্থ হইয়াছে। জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী আরও দক্ষতার সহিত গত দশ মাস যাবৎ সেই নীতি ও সেই প্রচেষ্টা চালাইয়া আসিতেছেন। কিন্তু, পর্বত মুষিক প্রসব করিয়াছে। কাশ্মীর যে স্থানে ছিল, সেই স্থানেই আছে।

 উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গত ১লা জুন করাচীতে এসোসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকার বিশেষ সংবাদদাতার সহিত এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলিয়াছেন, “খালের পানি বিরোধ ও কাশ্মীর সমস্যা আমাদের উপর সাঁড়াশি অভিযানের দুইটি দিক।”... কিন্তু, “আমরা কিছুই করিতে পারি না। ভারত এতই শক্তিশালী যে, আমেরিকাসহ প্রত্যেকেই তাহারা বন্ধুত্ব কামনা করে।”

 এই খেদোক্তির ভিতর দিয়া জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজ নীতির ব্যর্থতা নিজে স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু তবুও কিসের মোহে জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই বন্ধ্যা নীতি আঁকড়াইয়া রহিয়াছেন, তাহা তিনিই জানেন।