আমাদের প্রধানমন্ত্রী জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফর করিতেছেন। সেখানে গিয়া তিনি প্রেসিডেণ্ট আইসেনহাওয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং মার্কিন সিনেটে বক্তৃতা করেন এবং প্রেসিডেণ্ট আইসেনহাওয়ারের সংগে একটি যুক্ত ঘোষণা প্রকাশ করিয়াছেন।
যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়া জনাব সোহরাওয়ার্দী যেসব উক্ত করিয়াছেন এবং যে যুক্ত ঘোষণা প্রচার করিয়াছেন তাহার প্রত্যেকটিতে তিনি আমেরিকা বৈদেশিক নীতির প্রতি সমর্থন জানাইয়াছেন। কিন্তু প্রতিদানে পাকিস্তান কি পাইয়াছে? পাক-মার্কিন যুক্ত ঘোষণার দেখা যায় যে, কাশ্মীর ও খালের পানি বিরোধের মত পাকিস্তানের জীবনমরণ সমস্যাকে প্রেসিডেণ্ট আইসেনহাওয়ার ‘আঞ্চলিক সমস্যা’ বলিয়া আখ্যায়িত করিয়া শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করিয়াছেন মাত্র কিন্তু এসব সমস্যায় পাকিস্তানের সমর্থনে তিনি কোন স্পষ্টোক্তি করেন নাই। অথচ জাতিসংঘ নিরপেক্ষ ভোট গ্রহণ দ্বারা কাশ্মীর সমস্যা সমর্থনের কথা বলিয়াছে।
জনাব সোহরাওয়ার্দী মার্কিন কংগ্রেসে যে বক্তৃতা করেন তাহাতে তিনি কাশ্মীর ও খালের পানি বিরোধ সম্পর্কে উল্লেখ করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু আমেরিকার শাসকবর্গের “অনুরোধে” আমাদের প্রধানমন্ত্রী জনাব সোহরাওয়ার্দী নাকি তাহার বক্তৃতা হইতে কাশ্মীর ও খালের পানি বিষয়ক, কতিপয় বিষয় শেষ পর্যন্ত বাদ দিয়া দেন। লক্ষ্য করিবার বিষয় যে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের বক্তৃতায় জনাব সোহরাওয়ার্দী কাশ্মীর ও খালের পানি সম্পর্কে কোন কথা বলেন নাই।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়া যদি নিজের কথা অবাধে বলিতে না পারেন, সেখানে যদি তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা হয়, তাহা হইলে কি ইহাই প্রমাণিত হয় না যে যুক্তরাষ্ট্রের সহিত “বন্ধুত্বের” বিনিময়ে আমরা আমাদের সর্বপ্রকারের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতেছি?
কাশ্মীর পাওয়ার জন্য সম্রাজ্যবাদীদের উপর নির্ভর করার যে নীতি মুসলিম লীগ সরকার অনুসরণ করিয়া গিয়াছেন এবং যে নীতি বর্তমানে জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী অনুসরণ করিতেছেন; সেই নীতি আজ বাস্তবে বন্ধ্যা ও দেউলিয়া বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে।
ঐ বন্ধ্যা ও দেউলিয়া নীতিতে যে সুদীর্ঘ সময় নষ্ট করা হইয়াছে তাহার সুযোগে ভারত সরকার কাশ্মীরে তাহার অবস্থানকে সুদৃঢ় করিয়া ফেলিতেছে। আমাদের সরকার কাশ্মীরকে ভারতের হাতে তুলিয়া দেওয়ার জন্য দায়ী। পক্ষান্তরে, কাশ্মীর পাওয়ার যুক্তিতে সরকার যেসব সামরিক চুক্তিকে যোগদান করিয়াছেন তাহার শর্তগুলির ফলে পাকিস্তানের আজাদী ও সার্বভৌমত্ব বিপদগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছে। আমরা কাশ্মীর ও পাইলাম না এবং আমাদের আজাদী ও সার্বভৌমত্বও বিনষ্ট হইতেছে। ইহাই মুসলিম লীগ সরকার ও জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্র নীতির ফল!
পরিশেষে আমি ইহাই বলিতে চাই যে যুগ যুগ ধরিয়া আমাদের পূর্বপুরুষগণ মুক্তি ও গণতন্ত্রের যে আদর্শ নিয়া সংগ্রাম করিয়া গিয়াছেন, যে আদর্শ ও প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হইয়া আমরা পাকিস্তান সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলাম সেই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আদর্শ আজও বাস্তবে রূপায়িত হয় নাই। আমাদের স্বাধীন পাকিস্তান অর্জনের পর দশ বৎসর অতিক্রান্ত হইলেও মজলুম জনসাধারণের জীবনে স্বাধীনতার ছোঁয়াচ লাগে নাই। পাকিস্তানের কোটি কোটি মজলুম নরনারী আজও নিষ্পেষিত, অত্যাচারিত ও শোষিত।
স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও জনসাধারণের আর্থিক দুর্গতি নিরসনের সওয়াল নিয়াই একদা আওয়ামী লীগ গড়িয়া উঠিয়াছিল। সেই আওয়ামী লীগের নেতারাও আজ ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাঁহাদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি খেলাফ করিতেছেন। এবং আওয়ামী লীগ সংগঠনকে উহার নীতি ও আদর্শ হইতে বিচ্যুত করিয়াছে।