পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৭৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খন্ড
৭৬৫

 বার বার প্রতারিত হইয়া দেশের জনসাধারণের মনে সন্দেহ জাগিতেছে এবং তাহারা নিরাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হইতেছেন।

 উপসংহারে আমি বলিতে চাই যে সত্য ও মিথ্যার লড়াই, শোষক ও শোষিতের লড়াই, জমিদার ও প্রজার, সুদখোর মহাজন ও খাতকের লড়াই, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্যবাদের লড়াই, ধর্ম-অধর্মের লড়াই, বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন যেখানেই হইয়াছে তাহাতে যে সমস্ত নেতা ও কর্মী অংশগ্রহণ করিত তাহাদের ত্যাগ, কোরবানী, নির্যাতন ভোগের মাপকাঠিতে সেই সংগ্রাম বা লড়াই ততটা সাফল্য লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছে। উহার নজীর বিশ্বনবী ও তাঁহার ছাহাবদের জীবনের ও বর্তমান নবীন চীনের মুক্তি উন্নতির ইতিহাস আমাদের সম্মুখে মওজুত।

 পাক-ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বহু লোকের বহু ত্যাগ ও কোরবানীর ইতিহাসও আমাদের সম্মুখে মওজুত আছে। কিন্তু ঐ সমস্ত ত্যাগী দেশ প্রেমিকদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীনতার পূর্বে অথবা কিছুদিন পরেই আমাদিগকে চিরদিনের জন্য তাহাদের সাধনা ও আদর্শ হইতে বঞ্চিত করিয়া আল্লাহর ইচ্ছায় পরলোক গমন করিয়াছেন। আজ যাহারা পাকিস্তানের কর্ণধার ইহাদের মধ্যে যখনই যে দল ক্ষমতা দখল করিয়াছে তাহাদের মধ্যে খুব কম লোকই আছেন যাহারা স্বাধীনতা সংগ্রামে কোন প্রকারের কোরবানী বা নির্যাতন ভোগ করিয়াছেন। নির্যাতিত নেতা যেরূপভাবে দেশের নির্যাতিত জনসাধারণের প্রতি দরদ রাখে যাহারা জীবনে কখনো জালেমের জুলুমে পতিত হন নাই তাহাদের পক্ষে দেশের লোকের প্রতি সেরূপ দরদ রাখা সম্ভবপর নহে।

 তাই আজ আমার মনে হয় যদি মরহুম কায়েদে আজম, মরহুম মওলানা মোহাম্মদ আলী, হেকিম আজমল খাঁ, মওলানা শওকত আলী, মওলানা আজাদ সোবহানী, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস প্রভৃতি ত্যাগী মহাপুরুষগণ জীবিত থাকিয়া পাকিস্তানের উভয় অংশের কর্ণধাররূপে শাসন পরিচালনা করিতেন তাহা হইলে আজ দশ বৎসরে আল্লাহর মর্জি পাকিস্তানের আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ধর্মীয় ও নৈতিক উন্নতি বহুলাংশে বৃদ্ধি পাইত। বিশেষ করিয়া প্রায় দুইশত বৎসরকাল বিদেশী ইংরেজের শাসন ও শোষণের তিক্ত অভিজ্ঞতা স্মরণ করিলে পাকিস্তানের বর্তমান কর্ণধারগণ যেভাবে পুনরায় বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী ও শোষকদের নিকট সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করিবার জন্য সামরিক চুক্তি করিয়া পুনরায় দেশবাসীকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন তাহাতে শঙ্কিত না হইয়া উপায় নাই। উপরোল্লিখিত মরহুমেরা রাজনীতি করিতেন দেশ ও জাতিকে দেশী-বিদেশী সকল শ্রেণীর শোষকদের কবল হইতে মুক্ত করিয়া দেশ ও জাতিকে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী করিবার জন্য। বর্তমানে যাহারা রাজনীতি করেন তাহাদের মধ্যে অধিকসংখ্যক লোকই ক্ষমতা লাভ ও নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য। তাই দেখা যায় ক্ষমতা লাভের পূর্বে যাহাদের বিশেষ কিছু সহায়-সম্পত্তি ছিল না, তাহারাও যখন ক্ষমতায় যান তখন কিছুকালের মধ্যেই নিজের জন্য ২৩ মনজেলা বাড়ী গাড়ী, আত্মীয় স্বজনের চাকুরী, পারমটি, লাইসেন্স ইত্যাদির সাহায্যে নিজ নিজ দলীয় মোসাহেব ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের অবস্থা আমূল পরিবর্তন করিয়া ফেলে। ইহা লক্ষ্য করিয়া পর পর বিভিন্ন দল গদী দখল করিবার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করিতে থাকে। দেশ জাতি ধ্বংস হইল কিনা তাহা লক্ষ্য করিবার দৃষ্টিভঙ্গি এখন পর্যন্ত যত দলের লোক ক্ষমতা দখল করিয়াছে তাহাদের মধ্যে সমষ্টিগতভাবে কোন দলের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয় নাই। প্রত্যেক দলের নেতারাই প্রতিযোগিতামূলকভাবে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ হাসেল করিতে আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছে ও করিতেছে। ইহার প্রতিকার না হওয়ার একমাত্র কারণ পাকিস্তানের মেরুদণ্ড পল্লীবাসীদের ভিতর সত্যিকার কর্মসূচী লইয়া আমরা সংগঠন স্থাপন করিতে পারি নাই। বর্তমানে যে কোন রাজনৈতিক দলই হউক না কেন তাহাদের শাখা, সমিতি, সামান্য যাহা কিছু কায়েম হইয়াছে তাহাতে গ্রাম্য প্রতিনিধি নাই বলিলেই চলে। অধিকাংশই শহরের উকিল, মোক্তার, ব্যবসায়ী ইত্যাদি শ্রেণীর লোক। গ্রামে বাস করে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৫ জন লোক, কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলেই তাহাদের সংখ্যানুপাত প্রতিনিধি নাই।