পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/১১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

76 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড জঙ্গীশাহীর সামরিক পাঁয়তারা পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী বাংলাদেশ-পাকিস্তান বিরোধকে সশস্ত্র পাক-ভারত বিরোধ রূপান্তরিত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। অবশ্য তাদের এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন পূর্বেই। তবে এতদিন তা প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল কূটনৈতিক ক্ষেত্রে। কিন্তু কূটনৈতিক ব্যর্থতা, জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী তীব্র ধিক্কার, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে দিশেহারা ও পাগলা কুকুরের মতই ক্ষিপ্ত এবং হিতাহিত জ্ঞানশূন্য পিণ্ডি ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহী এখন ভারতের সঙ্গে একটি যুদ্ধ বাধিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা এবং পাকিস্তান থেকে মুক্ত অঞ্চলে পাকিস্তানী জঙ্গশাহীর ব্যাপক সমর প্রস্ততির খবর পাওয়া যাচ্ছে। শতদ্রু নদীর দক্ষিণ তীর বরাবর পাকিস্তানের ব্যাপক সামরিক সমাবেশ লক্ষ্য করা গেছে। চাম্ব সীমান্তের কয়েকটি পাকিস্তানী গ্রাম থেকে অসামরিক অধিবাসীরা চলে গিয়েছে। মুক্ত অঞ্চল ও ভারতের সীমান্ত বরাবর দখলীকৃত বাংলাদেশে ব্যাপক সামরিক সমাবেশ, ভারী কামান ও অন্যান্য সমরাস্ত্র স্থাপনের খবর পাওয়া গিয়াছে। তাছাড়া ভারতের নদীয়া জেলার সীমান্তে বিনা প্ররোচনায় পাকিস্তানী সেনারা গোলাগুলীবর্ষণ করেছে। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোন রকমে ভারতের সঙ্গে একটা যুদ্ধ বাধিয়ে পাকভারতের বিরোধের আবরণে বাংলাদেশ সমস্যাকে চাপা দেয়া এবং এই উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনের অজুহাতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তদারকির ছত্রছায়ায় বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বন্ধ করে পাক জঙ্গীশাহীর আত্মরক্ষার চেষ্টা। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম যে জয়যুক্ত হবেই এবং বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পাততাড়ি ঘটি-বাটি গুটোতে হবেই এটা জঙ্গীশাহী হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছে। অথচ তাদের দেশবাসীকে কিম্বা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত সৈনিকদের পরিবার পরিজনকে বাংলাদেশে সামরিক এ্যাডভেঞ্চারের ব্যর্থতার কৈফিয়ত দেয়া সহজ হয়। তাই একান্তপক্ষে তাদের নিজ দেশের অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের কাছে মুখ রক্ষার জন্যে পাক ভারত বিরোধের মতো আর একটি সামরিক এ্যাডভেঞ্চারের ঝুকি নেবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের ঘটনায় পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী বিশ্বের কাছে মুখ পায়নি। এখন তাকে পাক ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করলে বিশ্বে কিম্বা নিজ দেশের জনগণের কাছে মুখ থাকবে কিনা তা আমাদের গবেষণার বিষয় নয়। তবে সূত্র ধরে যদি এদেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলের আগমন ঘটে এবং তারা যদি বাংলাদেশের জনগণ, গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার ও দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধারা তা সহ্য করবে না। পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী যখন বাংলাদেশে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে, মা বোনদের ইজ্জত নষ্ট করেছে, ধন সম্পদ লুণ্ঠন করেছে ও ঘরবাড়ী জুলিয়ে দিয়েছে, নববই লক্ষাধিক মানুষকে দেশছাড়া এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের অধিকার হরণ করেছে তখণ জাতিপুঞ্জ কোন মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালন করেনি। এখন এই উপমহাদেশে শান্তির নামে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের আশা আকাঙ্খা ও জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের পথে কোন অন্তরায় সৃষ্টির চেষ্টাকেই তারা মানবে না। তবে তারা সত্যই যদি এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি চান, তাহলে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে চলে যেতে বাধ্য করুন। বাধ্য করুন বঙ্গবন্ধুশেখমুজিবকে মুক্তি দিতে এবং স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে মেনে নিতে। এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তির এটাই পথ, পাক জঙ্গীশাহীর সামরিক এ্যাডভেঞ্চারিজম নয়।