পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/২৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

254 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড অবকাশ নাই। সুতরাং ধরিয়া নেওয়া যায়, পাকিস্তান টাইমসে যে খসড়া শাসনতন্ত্রের বিবরণী ছাপা হইয়াছে, উহাই প্রকৃত জল্লাদী শাসনতন্ত্র। বাংলাদেশ এখন আর ইয়াহিয়া খানদের খাস তালুক নয়। বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশের ব্যাপারে জঙ্গীশাহী কোন কথা বলিলে তা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপেরই সামিল হইবে। সে কারণেই ইয়াহিয়ার শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলা নিয়া আমাদের কোন মাথাব্যথা নাই। কিন্তু তবু এ ব্যাপারে মন্তব্য করিতেছি আমরা শুধু এই কারণে যে, জল্লাদের এই সর্বশেষ তৎপরতার অন্তরালে রহিয়াছে এক সুগভীর চক্রান্ত। এ চক্রান্ত ভয়াবহ মারাত্মক, জঘন্য ইহার লক্ষ্য। আমরা আগেই বলিয়াছি, উপনিবেশবাদী পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক-শোষকদের উদ্দেশ্য হইতেছে যে কোন প্রকারে হইক বিভেধ বিদ্বেষ তিক্ততা সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালী জাতির মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করিয়া তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখিয়া বাংলাদেশকে পণ্য সামগ্ৰী বিক্রয়ের খোলা বাজার হিসাবে ব্যবহার করা এবং বাংলার মাটির সোনার সম্পদ ও বাঙালীর হাড়-মাংস-কলিজা হরিলুটের বাতাসার মত কামড়াইয়া ছিড়িয়া খাওয়া। আর এই বদমতলব হাছিলের জন্য গণবিরোধী পশ্চিমা শাসককুল ছল বল কল কৌশল কম প্রয়োগ করে নাই। ন্যায্য দাবী-দাওয়া প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশে যখনই কোন গণআন্দোলন দানা বাঁধিয়া উঠিয়াছে, নির্যাতন, নিপীড়নের ষ্টীম রোলার চালাইবার পাশাপাশি তখনই পশ্চিমা শাসকরা হিন্দু-মুসলমান, বাঙ্গালীঅবাঙ্গালী, স্থানীয়-অস্থানীয় প্রশ্ন উস্কাইয়া দিয়া বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণের মধ্যে বিভেদ-বিদ্বেষ, সংঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে উহা বানচাল করিয়া দেওয়ার চেষ্টা করিয়াছে। সাম্প্রতিক অতীতকালেও দেখা গিয়াছে, ১৯৬৯ সালের প্রদেশ গঠনের দাবী। তারপর ওঠে পৃথক উত্তরবঙ্গ প্রদেশ গঠনের দাবী। কিন্তু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে স্বার্থবাদীদের এই অপপ্রয়াস ব্যর্থ হইয়া যায়। তারপর আসে বিগত নির্বাচন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালী জাতি অতুলনীয় ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ হয়। পাকিস্তানে বাঙ্গালীরা ছিল শতকরা ৫৬ ভাগ। এক লোক এক ভোটের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগন আওয়ামী লীগের হাতে সমগ্র পাকিস্তানের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের বৈধ অধিকার তুলিয়া দেয়ায় বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত হন সমগ্র পাকিস্তানের ভাগ্য বিধাতা হিসাবে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক ও শোষককুল জনগণের এই রায়কে সহজভাবে গ্রহণ করিতে পারে নাই। আর তার ফলে পরবর্তীকালে কি ঘটিয়াছে, কিভাবে জঙ্গীশাহী হিংস্র বর্বরতায় বাংলার মানুষের উপর পশুর মত ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে, কিভাবে শ্যামল বাংলার বুকে দশ লক্ষ মানুষকে ঘরছাড়া নিঃস্ব কাঙ্গালে পরিণত করিয়াছে এবং সর্বোপরি ইয়াহিয়ার নিজের ভাষায় পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করিয়া তাহার জীবননাশের উদ্দেশ্যে বিচার প্রহসনের ষড়যন্ত্রে মাতিয়া উঠিয়াছে, সে কাহিনী সকলেরই জানা। আর ইহাও সকলেরই জানা যে, বর্বরতার দ্বারা বাঙ্গালী স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করিয়া দেওয়া সম্ভব হয় নাই- সম্ভব হইবে না। নির্মম বাস্তবের এই প্রতিকূল সূর্যরশ্মির সামনে দাঁড়াইয়া জল্লাদশাহী তাই নতুন কৌশলের আশ্রয় লইয়াছে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারাই শাসনতন্ত্র রচনার পূর্বপ্রতিশ্রুতি বিস্মৃত হইয়া ইয়াহিয়া খান এখন মাতিয়া উঠিয়াছে স্বকপোল কল্পিত এক শাহী ফরমানের উপর শাসনতন্ত্রের লেবেল লাগাইয়া উহাই জনগণের উপর চাপাইয়া দেওয়ার তোঘলকি খেয়ালে। জঙ্গীশাহী জানে, স্বাধীনতার যুদ্ধ বাঙালী জাতির ঐক্যকে যেভাবে সুদৃঢ় ও সুসংহত করিয়াচে উহার কোন দ্বিতীয় নজির নাই। তারা জানে যে, এই ঐক্যে ফাটল ধরাইতে না পারিলে নিজেদের দূরভিসন্ধি হাসিলের কোন আশা নাই। তাই এই ঐক্যে ফাটল ধরাইবার সুচতুর কৌশল সংযোজিত হইয়াছে জল্লাদী শাসনতন্ত্রের খসড়ায়। ইয়াহিয়া চক্রের ধারণা, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় তিনটি প্রদেশ গঠিত হইলে বাঙ্গালীরা আর এক কণ্ঠে এক জাতি হিসাবে কথা বলিবার সুযোগ পাইবে না। বরং উল্টো, ক্ষমতা, দাবী-দাওয়া এবং স্বার্থের প্রশ্নে