পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/২৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

257 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড বরং অধিকতর শক্তি ও উদ্যম লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে হানাদার দুশমনের উপর। ক্রমাগত পর্যুদস্ত হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া খুজিয়া ফিরিতেছে পরিত্রাণের উপায়। মৃত পাকিস্তানে প্রাণসঞ্চার, পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদের বিলীয়মান সৌধটিকে কোন মতে টিকাইয়া রাখা এবং নিজের জঙ্গী মসনদ খাড়া রাখার জন্য সে আপোষের আরজি লইয়া ইরান তুরানের দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিয়াছে, দূত পঠাইয়াছে তারই ভাষায় দেশদ্রোহী এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দায়ে বিচারাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে। কিন্তু, পূর্ববর্তী খবরেই বলা হইয়াছে, বাংলার মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু এই আপোষ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করিয়া দিয়া বলিয়াছেন, লক্ষ লক্ষ বাঙালীর নরমুণ্ড লইয়া গেণ্ডুয়া খেলায় লিপ্ত জল্লাদের সঙ্গে আপোষের কোন প্রশ্নই ওঠে না। এ, কে, ব্রোহীর মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রস্তাব পাঠাইয়াছিল যে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরতি ঘোষণা করিয়া পাকিস্তান এক রাখিতে সম্মত হইলে শেখ সাহেবকে মুক্তি দেওয়া হইবে। কিন্তু কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়া একটি বিদেশী বার্তা সংস্থা জানাইয়াছেন, বঙ্গবন্ধু জল্লাদী দূতের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাইয়া দিয়াছেন যে, ‘বাঙালীর রক্ত আর স্বাধীনতার সঙ্গে বেঈমানী করিয়া আমার কারামুক্তিলাভের কোন প্রশ্নই ওঠে না।’ এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বিগত মার্চ মাসের ১ তারিখ হইতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হইলে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কিছুসংখ্যক ছাত্র-জনতা পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন। বঙ্গবন্ধু সেই সময় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকেই ন্যায়তঃ আইনতঃ বাংলাদেশের রাষ্ট্ৰীয় ক্ষমতায় সমাসীন বলিয়া মানিয়া নিয়া প্রতিটি ব্যাপারে অক্ষরে অক্ষরে তাঁহার নির্দেশ পালন করিতে থাকে। ৬ই মার্চ ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ১০ই মার্চ ঢাকায় নেতৃত্ব সম্মেলন আহবান করেন। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণে উহার জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘কার সঙ্গে বৈঠক, কিসের বৈঠকে বসিব? যে আমার মানুষের বুকে গুলি চালাইয়াছে তার সাথে? সেই ভাষণেই বঙ্গবন্ধু বলেন, রক্ত যখন দিয়াছি রক্ত আরও দিব, কিন্তু বাংলার মানুষকে এবার মুক্ত করিয়া ছাড়িব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তারপর বহুদিন গত হইয়াছে, পরিস্থিতি, প্রেক্ষিত সবকিছুই আমূল পাল্টাইয়া গিয়াছে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙ্গালী জাতি লিপ্ত হইয়াছে মুক্তিযুদ্ধে। বাঙ্গালীর আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন বানচালের জন্য ইয়াহিয়া খান হিংস্র বর্বরতায় হত্যা করিয়াছে দশ লক্ষ মানুষ, নিরাশ্রয় গৃহহারা দেশান্তরী করিয়াছে লক্ষ লক্ষ নরনারী-শিশুকে। এই হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাতের তুলনায় ৭ই মার্চের পূর্ব পর্যন্ত পশ্চিমা সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহতের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। তবু সেদিনের সেই বীর শহীদের চাপ চাপ রক্তের উপর দিয়া হাঁটিয়া গিয়া বঙ্গবন্ধু জল্লাদের সঙ্গে বৈঠকে বসিতে রাজী হন নাই। সামরিক শাসন প্রত্যাহার, ক্ষমতা হস্তান্তর, সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং ক্ষতিপূরণ দানের আগে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে সম্মত হন নাই। আজ দশ লক্ষ বাঙ্গালীর রক্তের নদী সাঁতরাইয়া বঙ্গবন্ধুরই মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত বাঙ্গালী জাতি এবং তাহার অনুসারীরা জল্লাদ ইয়াহিয়ার সঙ্গে আপোষ করিতে যাইবে এমন কথা যারা চিন্তা করেন, বা এমন বিভ্রান্তিকর ধারণাকে যারা ক্ষণিকের তরেও মনে ঠাই দেন, তারা আহাম্মকের স্বর্গেই বাস করিতেছেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যে কোন মতেই আপোষ হইতে পারে না, বাংলাদেশ সরকার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ইহা জানাইয়া দিয়াছেন। বিগত ৬ই সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক বাংলার বাণীর সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাহার পূর্ব ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করিয়া বলেন- ইয়াহিয়া খানকে সর্বপ্রথম শেখ মুজিবের মুক্তি দিতে হইবে, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হইবে, হানাদার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করিয়া নিতে হইবে এবং জঙ্গী বর্বরতায় ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে।” এই সব দাবী পূরণের পরই বিবেচনা করা হইবে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আমরা আলোচনায় বসিব কিনা! গত ২৫শে সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধের অর্ধ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বেতার ভাষণেও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করেন। একই দিনে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের