পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/২৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

261 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড বালির ঘূর্ণাবর্তী চম্ব সীমান্তে সমস্ত বেসামরিক নাগরিকদের দূরে সরাইয়া নেওয়া হইয়াছে। কিন্তু কেন? ইহা কিসের আলামত? নিঃসন্দেহে যুদ্ধের সন্দেহতাতীভাবেই পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর এই রণ পায়তারার লক্ষ্য হইল ভারত। আর এখানেই আসিতেছে আসল কথা। এখানেই নিহিত জঙ্গীশাহীর জঘন্যতম দূরভিসন্ধি। সারা দুনিয়ার মানুষ জানে, বাংলাদেশের মানুষ পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদের শেষ প্রতিভূ ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনীর সঙ্গে জীবনপণ যুদ্ধে লিপ্ত। এই যুদ্ধে একদিকে মাতৃভূমিকে শক্রমুক্ত করার সুমহান সংকল্পে উজ্জীবিত বাঙ্গালী জাতি, অপরদিকে রহিয়াছে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী। কিন্তু এই বাস্তব সত্যটিকে অস্বীকার করিয়া ইয়াহিয়া খান আগা গোড়াই চেষ্টা চালাইয়াছে ইহার মধ্যে ভারতকে টানিয়া আনিতে। ভারত বার বার সুস্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছে বাংলাদেশের যুদ্ধে, বাংলার মানুষেরই মুক্তিযুদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার এই যুদ্ধে ভারতের কোন ভূমিকা নাই। বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, সত্যের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম বলিয়াই বিশ্বের বৃহত্তর গণতন্ত্রী রাষ্ট্র ভারত স্বৈরতন্ত্রী উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত এই সংগ্রামে বাঙ্গালী জাতির প্রতি নৈতিক সমর্থন জানাইয়াছে। ইহাতে দোষের কি আছে? চীন যদি সর্বহারা নিপীড়িত মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া উপনিবেশবাদী পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীকে অস্ত্র যোগাইতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ইয়াহিয়ার হাতে অঢেল মারণস্ত্ৰ তুলিয়া দিতে পারে, তবে ভারতই বা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করিতে পরিবে না কেন? কিন্তু বর্বর পশুশক্তির কাছে যুক্তির কোন মূল্য নাই। তার আজ প্রয়োজন যে কোনভাবে হউক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করিয়া দিয়া সারে সাত কোটি বাঙালীকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখা। আর এই জঘন্য উদ্দেশ্য হাছিলের জন্যই ইয়াহিয়া আজ ভারতের বিরুদ্ধে রণপীয়তারা চালাইতেছে। একথা একটা বালকেরও বুঝিতে কষ্ট হইবার কথা নয় যে যুদ্ধে ভারতের বিরুদ্ধে জয়লাভ করার সাধ্য পাকিস্তানের নাই। কিন্তু তবু ইয়াহিয়া খান লাফাইতেছে কেন? কাহার ইঙ্গিতে, কিসের জোরে সে নর্তন-কুর্দন করিতেছে? উত্তরঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উদ্দেশ্যঃ বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন নস্যাৎ করিয়া দেওয়া। এই উদ্দেশ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও মার্চ মাসের পরে ইয়াহিয়ার হাতে পৌনে সাত কোটি টাকার মার্কিন অস্ত্ৰ তুলিয়া দিয়াছে। আর এই চৌর্যবৃত্তির পাপকে ঢাকা দেওয়ার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম রজার্সের কণ্ঠে উচ্চারিত হইতেছে দুরভিসন্ধিমূলক সংযমের ললিত বাণী। ইয়াহিয়া খান জানে, তার ভাড়াটিয়া বাহিনী ভারত আক্রমণ করিলে ভারত উহার সমুচিত জবাব দিতে এতটুকু দ্বিরুক্তি করিবে না। এই যুদ্ধ হইবে সত্য সত্যই এক সর্বাত্মক যুদ্ধ। দাবালনের মত এই যুদ্ধ দ্রুত ছড়াইয়া পড়িলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। আর সে ক্ষেত্রে এই যুদ্ধবন্ধ করার জন্য সম্ভবতঃ সবার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই জাতিসংঘকে পাঠাইবে শান্তি ও সন্ধির প্রস্তাব লইয়া হয়তো বা যুদ্ধ বিরতি ঘটিবে। আলোচনা বৈঠকে সামনা-সামনি বসিবে ভারত ও পাকিস্তান। দুর্ভাগা বাংলা তার স্বাধীনতার দূর্বার স্বপ্ন বুকে লইয়া অবহেলায় পড়িয়া থাকিবে একান্তে। বাংলাদেশের উপর হইতে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি সরিয়া যাইবে পাকভারত সংঘর্ষের উপর। আর এই ভাবেই চাপা পড়িবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম। ইয়াহিয়া খান জানে তার ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনী যুদ্ধ করিয়া বাংলাদেশ দখলে রাখিতে পারবে না। তাই সে আজ উপরোক্ত কৌশলের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পদানত রাখিতে চায়। আর সে জন্যই চলিতেছে ভারতের বিরুদ্ধে তার চূড়ান্ত রণসজ্জা। কিন্তু শান্তিকামী বিবেকবান বিশ্ববাসী কি রণোন্মাদ ইয়াহিয়ার এই মানবতা-বিরোধী রণপায়তারার নীরব দর্শক হইয়া থাকিবে? পাক ভারত যুদ্ধ প্রতিরোধের জন্য, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু