পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৩১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

279 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড জাতিকীকরণের মার্কিনী দুরভিসন্ধির প্রথম প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে ভারতের উপর জঙ্গীশাহীর হামলা এবং নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠানের মার্কিনী প্রয়াসের মধ্যে একটি নিবিড় ঐক্যসূত্র রহিয়াছে। যোগ সূত্র রহিয়াছে প্রায় একই সঙ্গে পিণ্ডি ও পিকিং হইতে ভারতকে আক্রমণকারী আখ্যাদানের মধ্যে। আজ এই উপমহাদেশে কিছু ঘটিতে না ঘটিতেই একই সঙ্গে পিকিং-ওয়াশিংটনে মরণার্তি ধ্বনিত হয়, বৈঠক বসে নিরাপত্তা পরিষদের। কারণ বিশ্বশান্তি বিপন্নের দুয়া। কারণ, বিশ্বশান্তি রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব জাতিসংঘের। লংঘন আর গণহত্যা প্রতিরোধও কি জাতিসংঘের সুমহান প্রতিশ্রুতির অন্তৰ্ভূক্ত নয়? বিশ্বের মানুষ জানে ইঙ্গ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লেজুরবৃত্তি করার জন্য বা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আড্ডাখানা হিসাবে জাতিসংঘের জন্ম হয় নাই। জাতিসংগের জন্ম হইয়াছিল মানবাধিকার ও বিশ্বশান্তি রক্ষা- গণহত্যা রোধ আর মানবজাতির দেওয়া ভাড়াটিয়া ডালকুত্তা বাহিনী- দশ লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যা করিয়াছে, বাংলার শ্যামল মাটিতে রক্তের গঙ্গা বহাইয়াছে, নির্বিচারে মা-বোনের ইজ্জত লুটিয়াছে, ঘর-বাড়ী জনপদ জালাইয়া পোড়াইয়া ছাই করিয়াছে, লক্ষ লক্ষ নর-নারী শিশুকে গৃহহারা সর্বহারা দেশান্তরী করিয়াছে আর- কারান্তরালে নিক্ষেপ করিয়াছে স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সেদিন জাতিসংঘ টু শব্দটি করে নাই কেন? কেন সেদিন আজিকার এই যুদ্ধের উৎস জল্লাদী বর্বরতার বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারিত হয় নাই নিরাপত্তা পরিষদ বা খুনী নিক্সনের কণ্ঠে? আজো জল্লাদ ইয়াহিয়া তারই ভাষায় পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী’ বাংলার মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনের মঞ্চ সাজাইয়া তাহার জীবন লইয়া তস্কর সুলভ রাজনৈতিক জুয়াখেলায় লিপ্ত, কিন্তু তবু কেন নিক্সন নীরব, কেন নীরব জাতিসংঘ আর নিরাপত্তা পরিষদ? বরং উল্টা আজ যখন বাঙ্গালী জাতির মুক্তিযুদ্ধ সাফল্যের স্বর্ণতোরণের দ্বারপ্রান্তে, যখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে জল্লাদ ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া বাহিনীর মরণদশা, তখন টনক নড়িয়া উঠিয়াছে সাম্রাজ্যবাদী দস্যদের। ইসলামাবাদের খুনী দোসরদের পরিত্রাণের জন্য শুরু হইয়াছে প্রাণপণ প্রচেষ্টা। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া যা করিয়াছে, তার সেই হিংস্র বর্বরতা কারা ধৃষ্টতাপূর্ণ প্রচেষ্টারই সামিল। কারণ, বংলাদেশের জনগণের কাছে শেখ মুজিব আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পার্থক্য নাই। তবু কেন আজ বৃহৎ শক্তিবর্গ স্বাধীন দুনিয়ার নায়ক আর সুসভ্য গণতন্ত্রী বলিয়া পরিচিত পাশ্চাত্য দেশীয় শাসককুল একটিবারও ইয়াহিয়ার এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্র রক্ষা। সুতরাং এতদিন যে কথা বলিয়া আসিয়াছি উহাই আজ দিবালোকের মত সত্য হইয়া উঠিয়াছে। জঙ্গী ইয়াহিয়ার ক্ষয়িষ্ণু উপনিবেশবাদী দুঃশাসনের পতনোন্মুখ সৌধটি খাড়া রাখার উদ্দেশ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশ-দেশান্তরের গণবিরোধী শাসকচক্র চায় উপমাদেশের এই যুদ্ধকে আন্তর্জাতিককীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করিয়া দিতে। জল্লাদ ইয়াহিয়া আর তার মুরববীদের ধারণা জাতিসংঘ টেবিলের দুই পার্শ্বে বসিবে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান। আর শৃঙ্খলিতা দুঃখিনী বাংলা তার স্বাধীনতার স্বপ্ন, মুক্তির দুর্মর আকাঙ্ক্ষা বুকে লইয়া এক পার্শ্বে পড়িয়া থাকিবে অনাদৃত-অবহেলিত, শেখ মুজিব থাকিবেন জল্লাদের জিন্দাখানায়। আর এই ভাবেই নির্মুল হইয়া যাইবে বঙ্গবন্ধুর কারামুক্ত আর জননী বাংলার শৃঙ্খল অর্থনীতি কায়েমের উদ্দেশ্যে পরিচালিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাধারী বাঙ্গালী জাতির জীবনপণ মুক্তি সংগ্রাম।