পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৪২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

388 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড বিষাক্ত আস্বাদ পাইয়াছে। আর একটি কথা শুধু কর্মসূচী গ্রহণ করিলেই চলিবে না। শুধু এই কথা বলিলেও চলিবে না যে, স্বাধীনতার পর তোমাদের জীবনে আমরা সুখ সম্পদের বন্যা বহাইয়া দিব। তাই আজ বাংলাদেশের বুক হইতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে উৎখাত করার সংগ্রাম একদিকে যেমন চলিবে আবার অন্যদিকে এই লড়াইকে জনযুদ্ধের মাধ্যমে সফল করিয়া তুলবার স্বার্থেই গ্রামাঞ্চলে জোতদার মহাজনের প্রয়োজনতিরিক্ত মওজুত খাদ্যশস্য গরীব জনসাধারণের মধ্যে স্বল্প মূল্যে বিক্রয় করা, জোতদার মহাজনের জমিতে যে সমস্ত গরীব ও ভূমিহীন কৃষক বর্গাচাষ করে, তাহদের ফসল পূর্বের তুলনায় বেশী দেওয়া মহাজনের নির্মম শোষণ বন্ধ করা, জমির সিলিং নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া, জাতীয় শত্রদের সম্পত্তি সম্পূর্ণ বাজেয়াপ্ত করিয়া গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা প্রভৃতি কর্মসূচী গ্রহণ করা একান্তভাবেই প্রয়োজন। তাহা হইলেই কৃষকের মধ্যে এক প্রচণ্ড উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হইবে এবং তাহারা বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়িবে। তাই ইহা পরিস্কার যে, মুক্তিযুদ্ধকে সফল করিয়া তুলিতে হইলে ইহাকে দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধে পরিণত করা এবং তাহাকে কার্যকরী করার প্রক্রিয়া শুরু করার মাধ্যমে কৃষকের মধ্যে জাগরণের উত্তাল জোয়ার সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এই জন্যই দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধ এবং জনযুদ্ধ একটি অপরটির সহিত নিবিড় সম্পর্কযুক্ত। এই জন্যই আমরা এই কথা বলিঃ বৰ্ত্তমান সংগ্রাম যতই দীর্ঘ মেয়াদী হইতেছে, ততই জনযুদ্ধের বিপ্লবী উপাদান ইহার মধ্যে ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিধারায় সঞ্চারিত হইয়া চলিতেছে। এই কারণেই বাংলাদেশের বর্তমান লড়াইকে মাঝপথে থামাইয়া দিয়া একটি রাজনৈতিক সমাধানের’ গগনভেদী আওয়াজ উঠিয়াছে। ইহা অত্যন্ত সহজ কথা যে, বাংলাদেশের বর্তমান লড়াই দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়া জনযুদ্ধে পরিণত হইলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা পাক হানাদার বাহিনী কেন, দুনিয়ার কোন শক্তিরই থাকিবে না। ভিয়েতনামই তাহার উজ্জ্বলতম প্রমাণ। শুধু তাই নয়, জনযুদ্ধের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা আসিবে, সে স্বাধীনতার চেহারাই হইবে আলাদা। ইহা হইবে কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত এবং জাতীয় দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণী তথা সমগ্র জনতার স্বাধীনতা, যেখানে থাকিবে প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নূ্যনতম নিশ্চয়তা। কিন্তু বোধগম্য কারণেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আমাদের পুরাতন প্ৰভু বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং অন্যান্য কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাহা পছন্দ করিতে পারে না। সোভিয়েত রাশিয়া আমাদের সংগ্রামের প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়াছে। কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতন্ত্র উত্তরণ কিংবা একটি স্ফুলিঙ্গই বিশ্ব যুদ্ধের দাবানল সৃষ্টি করিয়া দিতে পারে’-এই তত্ত্বে বিশ্বাসী বলিয়া তাহারা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন প্রদান করা সত্ত্বেও ইহাকে রাজনৈতিক সমাধানের’ পথে লইয়া যাইতে চায়। ভারতের জনগণ ও সরকার আমাদের নৈতিক ও বৈষয়িক সাহায্য প্রদান করিতেছে। কিন্তু ভারত সরকার প্রথম হইতেই এই প্রশ্ন তুলিয়া ধরিতেছে যে তাহারা এক কোটি শরণার্থীর বোঝা আর কতদিন বহন করিবে ? আর ইহা তো অনস্বীকার্য সত্য যে, কোন বিদেশী রাষ্ট্রের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হইয়া একটি দেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলিতে পারে না। তাই বিভিন্ন মহল হইতে বাংলাদেশ প্রশ্নটির একটি রাজনৈতক সমাধানের বেপরওয়া প্রচেষ্টা শুরু হইয়াছে। এখন প্রশ্ন হইতেছেঃ কোন পথে এই রাজনৈতিক সমাধান কার্যকরী করার প্রচেষ্টা চলিতেছে ? শান্তিপূর্ণ পথে এই রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ইতিমধ্যেই ওয়াশিংটন, লণ্ডন এবং মস্কোতে ব্যাপক সূক্ষ্ম কুটনৈতিক তৎপরতা শুরু হইয়াছে। ইতিমধ্যে এই সমস্ত রাষ্ট্রের কুটনৈতিক প্রতিনিধিদের রাওয়ালপিণ্ডি, দিল্লী ও মুজিবনগরে ব্যাপক আনাগোনা চলিয়াছে বলিয়া বিদেশী সংবাদপত্রগুলিতে খবর প্রকাশিত হইতেছে। বলা বাহুল্য, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের অর্থই হইতেছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রশ্নটির রাজনৈতিক সমাধান’। কিন্তু এই ধরনের রাজনৈতিক সমাধানের পথে বাধা হইতেছেঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনতা, মুক্তিফৌজ এবং বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী।