পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৪২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

393 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর শাসন ও শোষণ চালাতে পারতো না। ‘৪৬-এ মুসলিম লীগকে জয়যুক্ত করে জিন্নার নেতৃত্ব দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নিয়ে বাংলার মানুষ যে ফাঁদে পা দিয়েছিল তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি স্বাধীন বাংলার কবর, ইউনিটারী পাকিস্তানের উদ্ভব। অবশ্য জিন্না এবং আর অবাঙালী নেতাদের বাঁচার আর কোন পথ ছিল না। ইউনিটারী পাকিস্তানে বাঙাল মারা কল বসাতে না পারলে তাঁদের সর্দার কায়েম রাখা যেতো না কিছুতেই। সে ব্যাপারে তাদের হিসাব ছিল একেবারেই নির্ভুল। এরপর এই তেইশ-চবিবশ বছরে বহুবার সেই একই খেলার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। শাসনতন্ত্র ছাড়াই দেশ চলেছে দশ বছর। দুই পরিষদের ভূত চাপাবার চেষ্টা হয়েছে। চেষ্টা হয়েছে পৃথক নির্বাচন বহাল রাখার। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করে বাংগাল'কে পাকিস্তানী বানাবার কোশেশ হয়েছে। সে সব অবশ্য ধোপে টেকেনি। কিন্তু ‘৫৪ সালের নির্বাচনের পর বাংলার মানুষ আবার ফাঁদে পড়েছে। মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়ে জয়ী হবার অল্প দিনের মধ্যেই যুক্তফ্রন্ট ভাংগন ধরলো। আওয়ামী লীগ বের হয়ে এলো যুক্তফ্রন্ট থেকে। নৌকার মাঝি হক সাহেব মাল্লাবিহীন হয়ে সমূদ্রে ভাসলেন। মাল্লার একের হাত-পা অপরে ভাংলো দাঁড়া-দাঁড়ি করে। নেতাদের সাথে এক ইউনিট আর সাংখ্যাসাম্য মানলেন শহীদ সোহরাওয়াদী। আর বিনিময়ে পেলেন চাকুরীবাকুরী, ব্যবসা-বানিজ্য, উন্নয়ন, সর্বক্ষেত্রে দুই অংশের সমান সমান বখরা কায়েম করার এবং গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র চালু রাখার অঙ্গীকার। কিন্তু এটাও ছিল আরেকটি ফাঁদ। বাংলাদেশ পরিষদের অভ্যন্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালো, পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্র দেশগুলি হারালো তাদের স্বকীয়তা। সোহরাওয়াদী উভয়ের কাছেই অপরাধী হয়ে থাকলেন। কিন্তু বিনিময়ে পেলেন না কিছুই। পশ্চিম পাকিস্তানীরা চুক্তির আর সব ধারা বেমালুম চেপে গেল। কোরান শরীফের পাতায় লেখা ওয়াদাও তারা ভাংতে পারেন কারণ ধর্মটা শোষকের খোলস, বিশ্বাসের অঙ্গ নয়। এই বিশ্বাসঘাতকতারই চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল বাংলার অধিকার নিয়ে চাপ সৃষ্টির পর আকস্মিকভাবে পাঞ্জাবী চক্রের সোহরাওয়াদী মন্ত্রসভার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারে। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত সুচতুর ও সুদক্ষ রাজনীতিকও নাকি সেদিন অসহায় শিশুর মত বলে উঠেছিলেন, “আমি মানবতার উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি।” তারপর ৫৯ সালের অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের ফলাফল পূর্বাহ্নে আঁচ করে সামরিক শাসন জারী থেকে শুরু করে, ৬২-র শাসনতন্ত্র জারী, ’৬৫-র নির্বাচন, ’৬৯-এর গোলটেবিল বৈঠক ‘৭০-এর নির্বাচন, একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি। প্রতিবারই বাংলার মানুষ নতুন করে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। প্রতিবারই প্রতারিত হয়েছে। ‘৬৯-র গোলটেবিল বৈঠকে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং পার্লামেন্টারী শাসনে প্রত্যাবর্তনের ঘোষণায় বিশ্বাস করেছে বাঙালী। সে বিশ্বাসের পরিণতি দ্বিতীয় দফা সামরিক শাসন, আয়ুবের গদীতে ইয়াহিয়ার অভিষেক। ‘৭০-এর নির্বাচনের জন্য ইয়াহিয়া যখন আইনগত কাঠামো আদেশ’ জারী করে, তখন বাংলাদেশের দু’একটি দল তাতে ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু বৃহত্তর জনসমষ্টি তা মেনে নেয়, ইয়াহিয়ার সদিচ্ছায় বিশ্বাস স্থাপন করে। ইয়াহিয়া সে বিশ্বাসের মূল্য তার স্বনিয়মেই দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে। কিন্তু কথায় আছে, সাতদিন চোরের আর একদিন গৃহস্থের। এবার সত্যই গৃহস্থের দিন এসেছে। ইয়াহিয়া এবং তার মুরববীদের সমস্ত হিসাব ভণ্ডুল করে দিয়ে বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে প্রতিশোধের স্পৃহায়। ২৪ বছরের বিশ্বাসঘাতক তার জবাব সে আজ দেবেই। ইয়াহিয়ার প্রতিটি অস্ত্র ফিরে গিয়ে তার নিজেরই বুকে বিধছে। বাংলাকে এবং বাংলার মানুষকে চিরতরে স্তদ্ধ করে দেবার জন্য যে চোরাবালির ফাঁদ পাতা হয়েছিল, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ইয়াহিয়া এবং তার সামরিক জান্তা আজ তাতেই আটকা পড়েছে। এ চোরাবালি থেকে তাদের নিস্তার অনিবার্য সমাধিতে।