পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৪৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

400 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড বাংলাদেশের মানুষ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে এবং বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবেই ক্ষমতায় রদবদল আনতে চেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন চক্র এই শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের পথ আগলে দাঁড়ায় এবং নজীরবিহীন নৃশংসতার মাধ্যমে নির্বাচনের রায় বানচাল করতে প্রয়াসী হয়। অতঃপর বাংলার ছাত্র-তরুণ ও স্বাধিকারকামী জনতা অস্ত্র ধরেছে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের পথে পা বাড়িয়েছে একান্ত বাধ্য হয়ে। এ থেকে অনেকে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে বাংলাদেশের ঘটনা নিয়মতান্ত্রিক পার্লামেন্টারী রাজনীতির ব্যর্থতার প্রামাণ্য উদাহরণ এবং এ থেকেই প্রামাণিত হয় যে সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া জাতীয় মুক্তি অসম্ভব। আওয়ামী লীগের তরুণদের একাংশ সশস্ত্র সংগ্রামের যৌক্তিকতা প্রচার করছিলেন পূর্ব থেকেই। এবার তাঁরা হাতে-কলমে তা প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছেন। অতঃপর পার্লামেন্টারী রাজনীতির ‘বিলাসিতা অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বর্তমান সংগ্রামকে তাঁদের নির্বাচনী বিজয়েরই চূড়ান্ত পরিণতি মনে করেছেন। তাঁদের মতে বর্তমান সংগ্রাম সশস্ত্র হলেও তা প্রকৃত প্রস্তাবে নিয়মতান্ত্রিক। কারণ, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের দেওয়া রায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই সংগ্রাম চলছে। কাজেই এ সংগ্রাম অন্যান্য দেশের সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এবং একে কোন অবস্থাতেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অবসান বলা যেতে পারে না। তাঁরা মনে করেন, ইয়াহিয়া নিয়মতান্ত্রিকতার পথ থেকে সরে গিয়ে যে অনিয়মের পথ বেছে নিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার সেই অনিয়মকে উৎখাত করে নিয়মতান্ত্রিকতাকেই পুনর্বহাল করতে চান। শত্রমুক্ত বাংলাদেশে তাঁরা গণপরিষদের অধিবেশন ডাকতে মুহুৰ্তও বিলম্ব করবেন না এবং যথারীতি পার্লামেন্টারী রাজনীতি কায়েম করবেন, এ কথা তাঁরা বলছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এ ধরনের বক্তব্য যদি দলের স্থিরসিদ্ধান্তের পরিচায়ক হয়ে থাকে তবে কার্যক্ষেত্রেও তার প্রতিফলন ঘটা দরকার বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিল সন্দেহ নাই। বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় পার্লামেন্টারী রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষ্যে আকর্ষণ এবং আস্থা দুই-ই বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু পরবর্তীকালের ঘটনা প্রবাহে গণমনে বিভ্রান্তি এসেছে। সে বিভ্রান্তি এখন বাড়ছে বই কমছে না। পাকিস্তানে কোনকালেই পার্লামেন্টারী রাজনীতি পরীক্ষিত হয়নি। শুরু থেকেই কায়েমী স্বার্থ এবং সামরিক বাহিনীর অন্যায় প্রভুত্ব দেশে পার্লামেন্টারী রাজনীতির বিকাশ স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে নস্যাৎ করে দেওয়া, ১৯৫৯ সালের অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের ভয়ে সামরিক শাসন জারী, আয়ুবের ‘মৌলিক গণতন্ত্র এবং সর্বশেষ ইয়াহিয়ার ডিগবাজী সেই অন্যায় প্রভুত্ব কায়েম রাখার অপকৌশলেরই বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ। স্বাধীন বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে প্রথম বারের মত সেখানে গণতন্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হবে। বলা বাহুল্য এটা একান্তভাবেই এখন আওয়ামী লীগের উপর নির্ভরশীল। সেজন্যে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই কয়েকটি ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। (১) দলীয় পরিধিতে নিয়মতান্ত্রিকতা কায়েম করতে হবে এবং সংগ্রামের সর্বস্তরে নিয়মতান্ত্রিক গণপ্রতিনিধিতুকে উর্ধ্বে তুলে রাখতে হবে। বিগত নির্বাচনে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, সরকার গঠন এবং সরকার পরিচালনায় তাঁদের সম্মিলিত ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং বর্তমান জরুরী অবস্থাতেও পার্লামেন্টের সুপ্রিমেসীর নিশ্চয়তা বহাল রাখতে হবে।