পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৪৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

442 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড বাধলে বাংলাদেশ প্রশ্ন চাপা পড়ে পাক-ভারত সমস্যার উদ্ভব হবে। তাহলে সামরিক বাহিনীর ভাঙনও রোধ হবে উপরন্তু বাংলাদেশ সমস্যার হবে অবসান। কিন্তু আমরা জানি ভারত একটি শান্তিকামী দেশ। যুদ্ধকে এড়িয়ে যেতে ভারত সদাসচেষ্ট। আর এই সম্ভাব্য যুদ্ধকে এড়িয়ে উপমহাদেশে শান্তি অক্ষুন্ন রাখতেই শ্রীমতি গান্ধী পশ্চিমা দেশগুলো সফরে যান। উপরোক্ত উদ্দেশ্যগুলোকে মনে রেখেই এবার বর্তমান সফরের মূল্যায়ন করে দেখা যাক। অষ্ট্রিয়া ও বেলজিয়ামে শ্রীমতি গান্ধীর সফর খুবই সার্থক হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু এটাও সত্য যে পাকিস্তানের উপর দুটো দেশের প্রভাব খুবই কম। তবে কোন দেশ থেকে সাহায্য না পেলেও তাদের কাছে অস্ত্রের জন্য ধর্ণা দেওয়া ইয়াহিয়ার পক্ষে মোটেই বিচিত্র নয়। কাজেই এই পথটিও এবার রুদ্ধ হয়ে গেছে। কারণ দুটো দেশই স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারতীয় নীতিকে পুরোপুরি সমর্থন জানানো হবে। এবং পাকিস্তানকে কোনরকম অস্ত্রই সাহায্য করা হবে না। এ দুটাে দেশের পর শ্রীমতি গান্ধী যান বৃটেনে। সেখানে আলোচনা হয় প্রধানমন্ত্রী হীথ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিউমের সাথে। বৃটেনের এই দুই নেতা পাকিস্তানের পক্ষে মত প্রকাশ করলেও তাঁদের পুরনো রক্ষণশীল নীতির কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। বৃটেনের এই দুই রাষ্ট্র শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আগ্রহ প্রকাশ করলে শ্রীমতি গান্ধী স্পষ্টই বলেছেন যে পূর্ব বাংলায় উপযুক্ত পরিস্থিতি ফিরে না এলে শরনার্থীরা সেখানে ফিরে যেতে পারে না। আর এজন্যে দরকার বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানজনক রাজনৈতিক সমাধান। বাংলাদেশ প্রশ্নে পাক-ভারত আলোচনার কোন প্রশ্নই ওঠে না। বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে ইয়াহিয়া খানকে বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধি আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সাথেই আলোচনায় বসতে হবে। শ্রীমতি গান্ধীর এই সঠিক বক্তব্যের পর বৃটেনের মনোভাব যে কিছুটা বদলেছে তার কারণ তারা বলতে শুরু করেছে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথভাবে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে বৃটেন সচেষ্ট হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও শ্রীমতি গান্ধীর সফর ফলপ্রসু হয়েছে। নিক্সন সরকার স্পষ্টই বলেছেন, পাকিস্তানকে আর অস্ত্র সাহায্য করা হবে না। তাছাড়া রাজনৈতিক সমাধানে তাঁর সরকার পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ দেবেন। অস্ত্র সাহায্য সত্যিই কি বন্ধ হবে- এ ব্যাপারে অনেকের মনেই হয়ত সংশয় আছে। তার কারণ ভারতের পররাষ্টমন্ত্রী শরণ সিং আমেরিকা সফর শেষে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন যে, আমেরিকা পাকিস্তানকে আর অস্ত্র সাহায্য করবে না। কিন্তু এর পর পরই আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র পাঠায়। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, একবার অস্ত্র সাহায্য বন্ধের কথা স্বয়ং নিক্সনই ঘোষণা করেছেন। সুতরাং সরাসরি ঘোষণা বরখেলাপের সম্ভাবনা খুবই কম। ফ্রান্সের নেতৃবৃন্দও রাজনৈতিক সমাধানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পম্পিদু শ্রীমতি গান্ধীর সম্মানে প্রদত্ত ভোজ সভায় বলেছেন যে পূর্ব বাংলার সংকট মূলতঃ রাজনৈতিক। বাংলাদেশের জনগণের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমেই এই সংকটের সমাধান করতে হবে। তা না হলে পাক-ভারত উপমহাদেশে অশান্তির ঝড় বইবে, যার ফল হবে খুবই মারাত্মক। পম্পিদুর বক্তব্যে বাংলাদেশ প্রশ্নে ফ্রান্সের দৃষ্টিভঙ্গ যে ভারতের অত্যন্ত কাছাকাছি সেটাই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।