পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

42 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড বাঁচবে না, অর্থাৎ বাংলাদেশের ধ্বংস চূড়ান্ত বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না। এই ধ্বংসস্তুপ ও মৃতদেহের স্তুপের উপর দাঁড়িয়েই জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষকরা তখন হয়ত দাবী করবেন, বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে গেছে তাতে আমাদের কি? আমাদের অপারেশন অভিযান সাকসেসফুল। জাতিসঙ্ঘ নামক একটি বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের যদি যথার্থই কোন অস্তিত্ব থাকতো, তাহলে তারা ভারতে তো দূরের কথা, বাংলাদেশেও পর্যবেক্ষক পাঠাবার নাম এখন মুখে আনতেন না। জাতিসঙ্ঘের কর্তা ব্যক্তিদের স্মরণ আছে কিনা আমরা জানি না, এপ্রিল মে মাসের দিকে দখলীকৃত বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যাযজ্ঞ যখন পুরোদমে চলেছে, তখন জাতিসঙ্ঘ সেখানে ত্রাণসামগ্রী পেরণ এবং নিজেদের তদারকিতে তা বন্টনের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। ইয়াহিয়া তখন আন্তর্জাতিক রেডক্রসের একটি টিমকেই শুধু পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার ভাষায় প্রস্তাব দেয়া হল, জাতিসঙ্ঘের ত্রাণসামগ্রী ইয়াহিয়ার সরকরী সংস্থাগুলোই বন্টন করবে, তবে তদারকি করবে জাতিসঙ্ঘের লোকেরা। এই প্রস্তাবটি প্রথমে ইয়াহিয়ার মনঃপূত হয়নি। ইয়াহিয়ার কাছে জাতিসঙ্ঘের আমল পায়নি। এমনকি তার পৈশাচিক গণহত্যা বন্ধ করতেও জাতিসঙ্ঘ পারেননি। আক্রমণকারী ও অত্যাচারীর বর্বরতা বন্ধ করতে সাহসের সঙ্গে না এগিয়ে দীর্ঘ চার মাস পর সক্রিয় হয়েছেন, পর্যবেক্ষক নিয়োগের নামে আক্রান্ত পক্ষের আত্মরক্ষার প্রস্ততি ও উদ্যোগ আয়োজন নষ্ট করার জন্য। এ না হলে আর জাতিসঙ্ঘ! আসলে জাতিসঙ্ঘ নামক বিশ্ব সংস্থাটির বহুদিন আগেই অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে। নিউ ইয়ার্কে জাতিসঙ্ঘ সদর দপ্তর নামে যে ভবনটি আছে, তা প্রকৃতপক্ষে একটি বৃহৎ শবাধার। আর এই শবাধারটি বহনের জন্য সর্বাগ্রে এগিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন এডমিনিষ্ট্রেশন এবং সর্বশেষ ব্যক্তি নিমন্ত্রিত হয়েছেন পাকিস্তান নামক একটি অধুনালুপ্ত রাষ্ট্রের বেআইনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। সব চাইতে মজার ব্যাপার এই যে, জাতিসঙ্ঘ ভারত সীমান্তেও পর্যবেক্ষক মোতায়েন করতে চেয়েছেন। এ যেন মামার বাড়ীর আবদার। ভারত সরকার অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে না বলে দিয়েছেন। তথাপি প্রশ্ন থেকে যায়, ভারতে পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে কি হবে? গৃহস্থ বাড়ীতে ডাকাত পড়েছে। ডাকাত না বেঁধে, গৃহস্থ বাঁধার এমন চমৎকার প্রস্তাব আর কখনো শোনা যায়নি। অপরাধ করেছে পাকিস্তান। সত্তর লাখ শরণার্থী সে ভারতের ঘাড়ে চাপিয়েছে। ভারত এই শরণার্থীদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়ে বিরাট মানবতাবাদী ভূমিকার পরিচয় দিয়েছে। এক্ষণে অপরাধী পাকিস্তানের সঙ্গে মানবতাবাদী ভারতকে একাসনে বসিয়ে ভারতের ঘাড়েও পর্যবেক্ষক বসিয়ে দেয়ার প্রস্তাব বাতুলতা না নতুন চক্রান্ত পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতেই তা বিচার্য। এখানে আরও একটি কথা বলা দরকার শরণার্থীরা ভারতে গিয়ে বিপন্ন হয়নি। এ জন্যেই পাকিস্তান ঘেঁষা জাতিসঙ্ঘ প্রতিনিধি প্রিন্স সদরুদিন ইয়াহিয়ার অনেক দুষ্কর্ম চাপা দিতে চাইলেও বলতে বাধ্য হয়েছেন ‘পাকিস্তানে ফিরে গেলে শরণার্থীদের জীবন বিপন্ন হবে না, এমন গ্যারান্টি আমি দিতে পারি না। যে স্বীকারোক্তির একমাত্র অর্থ , পাকিস্তানে এখনো অত্যাচার চলছে এবং দেশত্যাগীদের প্রত্যাবর্তন সেখানে নিরাপদ নয়। এই অবস্থায় জাতিসঙ্ঘের যদি সত্যই কোন দায়িত্ব বোধ থাকে, তাহলে তাদের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে অবিলম্বে অত্যাচারী হানাদার বাহিনী অপসারণের ব্যবস্থা করা এবং লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিরাপদ ও নিশ্চিত করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বালাদেশ সরকারকে তাদের বৈধ কর্তৃত্ব সম্প্রসারণে সাহায্য করা। তা না করে শরণার্থীদের জন্য মেকি দরদ দেখিয়ে বাংলাদেশে এবং ভারতে পর্যবেক্ষক প্রেরণের প্রস্তাব আসলে নতুন মোড়কে একটি পুরনো সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত মাত্র। জাতিসঙ্ঘ এই চক্রান্তেরই বহু ব্যবহৃত মাধ্যম। জাতিসঙ্ঘ পর্যবেক্ষক ও জাতিসঙ্ঘ বাহিনীর মোতায়েনের চমৎকার ফল বিশ্ববাসী একবার মধ্যপ্রাচ্যে এবং আরেকবার কঙ্গোতে প্রত্যক্ষ করেছে। জাতিসঙ্ঘের চমৎকার পর্যবেক্ষণ ও খবরদারি প্যালেষ্টাইনেও দেখেছে। কঙ্গোতে বিপুল ভোটাধিক্যে নির্বাচিত প্রথম জাতীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী লুমুম্বা দেশের আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসঙ্ঘ বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজ দেশে নিয়েছিলেন। এ জাতিসঙ্ঘ বাহিনীর নাকের ডগায় দাড়িয়ে কঙ্গোর ফ্যাসিষ্ট চক্র মহান দেশনায়ক লুমুম্বাকে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে।