পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

43 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড জাতিসঙ্ঘ এই হত্যাকাণ্ডের নীরব দর্শক ছিলেন মাত্র। সুতরাং বাংলাদেশের শরণার্থীদের সেবার অছিলায় সুচ হয়ে ঢুকে জাতিসঙ্ঘ কাদের জন্য ফাল হতে চান, তা বুঝতে বোকা বাঙালীরও খুব বেশী দেরী হয়নি। জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে এই নয়া চক্রান্তের উদ্দেশ্য অতি স্পষ্ট। দখলীকৃত বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী এখন ক্রমবর্ধিত গেরিলা তৎপরতায় কাবু হয়ে পড়েছে। মুক্ত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার প্রস্ততি নিচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং ইয়াহিয়ার হানাদার চক্রের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে তাদের নেপথ্যের মুরুবিবরা চাচ্ছে হানাদারদের এই চরম মার থেকে বাঁচাতে। পর্যবেক্ষক মোতায়েনের নামে যদি বাংলাদেশেও ভারত সীমান্তে জাতিসঙ্ঘ বাহিনী মোতায়েন করা যায়, তাহলে মুক্তিবাহিনী ও গেরিলাদের তৎপরতা রোধ করা যাবে এবং তাদের মার থেকে হানাদার বাহিনীকে বাঁচানোও যাবে, এই তাদের দুরাশা। পাকিস্তানকে এখনো অস্ত্র প্রদানের যুক্তি হিসাবে নিক্সন সরকার যে অভিনব তথ্য অবিষ্কার করেছেন, তাহল বাংলাদেশে উগ্রপন্থীদের দমনের জন্য অস্ত্র প্রেরণ দরকার। ভবিষ্যতে এই উগ্রপন্থীদের দমনের নামে মুক্তিবাহিনীকে দমনেরও এক চমৎকার যুক্তি নিক্সন সাহেবেরা খাড়া করতে পারবেন, বাংলাদেশে যখন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তখন সেখানে যারা উগ্রপন্থীদের অস্তিত্ব বা তাদের প্রভাব আবিষ্কার করতে পারেন, তাদের পক্ষে সবই সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্যবসায়ীদের এখন প্রধান ব্যবসা অস্ত্র বিক্রয়। ভিয়েতনামের কিছু উদ্ধৃত্ত মার্কিন সৈন্য জাতিসঙ্ঘ পর্যবেক্ষক বাহিনীতে ঢুকিয়ে যদি বাং পাঠানো যায়, তাহলে এখানেও আরেকটি ভিয়েৎনাম সৃষ্টিতে দেরী হবে না এবং মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীদের অস্ত্র ব্যবসায়ও ভাটা পড়বে না। যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিকামী ও গণতন্ত্রকামী মানুষেরও তাই উচিৎ, তাদের দেশের রক্ত ব্যবসায়ীদের এই নতুন চক্রান্ত সম্পর্কে সজাগ হওয়া। বাংলাদেশ সমস্যায় জাতিসঙ্ঘ যদি কোন কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে চায়, তার পথ এখনো উন্মুক্ত রয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার সাম্প্রতিক এক ভাষণে এই পথের কথাই সুস্পষ্ট ভাষাই বলে দিয়েছেন। এই পথ হল, বাংলাদেশ থেকে পাক হানাদার বাহিনী অবিলম্বে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকার ও জাতিসঙ্ঘে স্থান দেয়া, গত তেইশ বছর ধরে বাংলাদেশে যে শোষণ চালানো হয়েছে বিশেষ করে গত ২৫শে মার্চের পর ধ্বংস সাধন করা হয়েছে, ইসলামাবাদ সরকারের কাছে থেকে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করা ও শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনে সাহায্য করা। একমাত্র এ পথেই বাংলাদেশ সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত সমাধান সম্ভব। জাতিসঙ্ঘের তাই উচিৎ কোন নেপথ্য চক্রীদলের চক্রান্তের মাধ্যম না হওয়া এবং ভাওতাবাজির আশ্রয় না নেয়া। বাংলাদেশের মানুষ এখন অপরের কৃপাপ্রার্থী নয়। তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান ও হানাদার উৎপাদনে কৃতসংকল্প।