পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

63 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড পাকিস্তানী সামরকি জান্তা কর্তৃক সৃষ্ট সংকটের শিকার। কাজেই এই সংকটের সমাধানও নির্ভর করছে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করে নেয়ার মধ্যে, পাক-ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করার মধ্যে নয়। কিন্তু এই বাস্তব সত্য কি ইরানের শাহ স্বীকার করে নেবেন? ইয়াহিয়া-শাহ আলোচনার পর যে সংক্ষিপ্ত ঘোষণা প্রকাশিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশ সমস্যার ক্ষীণতম ইঙ্গিতও নেই। বরং যা আছে তা প্রকারান্তরে সমর্থনের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। কাজেই এই কথিত মধ্যস্থতার চরিত্র ও পরিণতি সম্পর্কে এর পরে আর কারো মনেই মোহ থাকবার কথা নয়। অবশ্য ইরাণের কাছ থেকে সত্যিকারের কোন গণতান্ত্রিক ভূমিকা আশা করা চলে না। ইরানের পূর্বাপর ভূমিকা আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, ইরানের রাজতন্ত্র এ পর্যন্ত কোন গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ও গণমুখী ভূমিকা গ্রহণ করেনি। মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতীয়তাবাদের প্রতি ইরান কোনদিন সক্রিয় সমর্থন তো দূরের কথা, নৈতিক সমর্থনও জানায়নি। বরং আরব জাতীয়তাবাদের জোয়ারে পাছে বিরোধিতাই করেছেন। এমন কি ইরানের মহান জাতীয়তাবাদী নেতা ডঃ মোসাদেককে পর্যন্ত ইরানী রাজতন্ত্রের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। অথচ এই ডঃ মোসাদেকই ইরানের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ইরান আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে এখনও একটি মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র বহাল রাখা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশীয়ায় নবজাগ্রত জাতীয় চেতনার ফলে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ ও শক্তির ভারসাম্য বিপন্ন হতে বসেছিল, ইরানের রাজতন্ত্র পেছন দুয়োর দিয়ে সেই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের বিশ্বস্ত প্রহরী হিসেবে কাজ করে আসছে। বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার চরম বিশ্বাসঘাতকতা ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার পরও ইরান গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে অর্থ ও সমর সম্ভার যুগিয়েছে বলে অভিযোগ শোনা গিয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিনিধিদেরকে সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়ে পরিণত করার উদ্দেশ্যে ইরানের শাহ নির্বাচনের পূর্বেও একবার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সে সময় ইসলামাবাদ হয়ে ইরানের শাহ আকস্মিকভাবে ঢাকা সফরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে এক সাক্ষাতে মিলিত হন। কিন্তু শেখ সাহেব যে জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়ে পরিণত হতে রাজী হননি, পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কর্তৃক বাংলাদেশের জনগণ ও জাতীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযান ও ঘৃণ্যতম গণহত্যার ইতিহাস থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে বিশ্ববিবেক জাগ্রত হলেও সাম্রাজবাদী সরকারসমূহের নিক্রিয়তা এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে পরোক্ষ সমর্থন ও উৎসাহ দানের ঘটনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ইরানের শাহ বা করিম আগা খানের মাধ্যমে বাংলাদেশে সাম্রাজবাদীরা কোন স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা অবশ্য জানি যে, ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করার প্রয়াসও তাদের ব্যর্থ হবে। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান নির্ভর করে কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর মুক্তিদান, বাংলাদেশ সরকারের হাতে শাসন ক্ষমতা অর্পণ এবং হানাদার বাহিনীর অপসারনের ওপরে। অন্যথায় নয়। ইরানের শাহের সত্যই যদি এই সমস্যা সমাধানের কোন সদিচ্ছা থাকে তাহলে ইয়াহিয়া সরকারের ওপরেই তিনি তাঁর প্রভাব বিস্তার করুন।