পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (সপ্তম খণ্ড).pdf/৪২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

388 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : সপ্তম খণ্ড জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ভোটারদের যাতে ভোটদানে কোন অসুবিধার সৃষ্টি না হয়, সে জন্য জনসাধারণ নির্বাচন পিছিয়ে দেবার দাবী জানায়। সে দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঠিক করলেন ১৯৭০ সালে ৭ই ডিসেম্বর। আর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট হলো ১৭ই ডিসেম্বর। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর ঘুর্ণিঝড়-দুর্যোগের কবলে পড়ে। বর্তমানে যুগের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে অভিহিত এই ঘূর্ণিঝড় পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় বাঁধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সকল নেতাগণ সাহায্য এবং পুনর্বাসনের কাজে মনোযোগ দেয়ার জন্য নির্বাচন আরো পিছিয়ে দেবার জন্য আবেদন জানান। নির্বাচন অভিযান স্থগিত করার নানা অসুবিধা থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান প্রধান নেতৃবৃন্দ নির্বাচন স্থগিত করায় তাদের সম্মতি প্রকাশ্য ভাবে ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান কিছুকাল একেবারে নীরব থাকার পর, প্রস্তাবিত স্থগিতের বিরুদ্ধে শুধু যে প্রতিবাদ জানালেন তাই নয়, কেন্দ্রীয় সরকারকে তীব্র আক্রমণ করে বললেন- পূর্ব পাকিস্তান জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তব রূপায়ণের জন্য আরো লক্ষ লক্ষ জীবন উৎসর্গ করা হবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন স্থগিত করলেন না। ১৯৭০ সালের ৩রা ডিসেম্বর এক ভাষণে তিনি বলেন- “এই সরকারের উদ্দেশ্য ও আন্তরিকতা নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য আর সে লক্ষ্যে আমরা অটল থাকবো।” সেই একই ভাষণে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে তিনি বরাবরই বলে এসেছেন যে শাসনতন্ত্র একটা সাধারণ আইন নয় বরং “একসঙ্গে বসবাস করা একটা চুক্তি”। আর সেইজন্যই শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে মতৈক্য বিশেষ প্রয়োজন। তিনি বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এবং বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে আমি এ কথাই বলতে চাই যে তারা তাদের নির্বাচন ও জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনের অন্তর্বতী সময় বেশ কাজে লাগাতে পারেন। তারা সকলে একত্রিত হয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের প্রধান বিধানগুলোর ব্যাপারে একমত হতে পারেন। এজন্য কিছুটা আদান-প্রদান দরকার, দরকার পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এই বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তার বিষয় উপলব্ধি করাও দরকার।” জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে* জাতীয় পরিষদের ভোটে দুটি রাজনৈতিক দল প্রধান হয়ে দেখা দেয়। তাদের একটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ, যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। অন্যটি হচ্ছে পাকিস্তান পিপলস পার্টি, যে ৮৫টি আসন লাভ করে। দুটি দলই সংগঠনের দিক থেকে আঞ্চলিক। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা সবাই পূর্ব পাকিস্তানী এবং পিপিপি'র সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানী। নির্বাচনের শেষে আশা করা হয়েছিলো যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই আইনগত কাঠামো আদেশে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের মধ্যে একটা সমঝোতায় এসে পৌঁছুবেন। আওয়ামী লীগ জোর দিয়ে একথাটাই বোঝাতে চাইছিলো যে এক পাকিস্তান কাঠামোর বাইরে ৬ দফায় কোন কিছুর পরিকল্পনা করা হয়নি। প্রেসিডেন্টকেও তারা এই ধারণা দিয়েছিলো। ১৯৭১ সালে ২৮শে জুনের বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট বলেনঃ “আমাদের আলাপ আলোচনা চলাকালে আমি যখন মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলাম তিনি আমার কাছে স্বীকার করেছিলেন যে সেগুলোর রদবদল সম্ভব। তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন যে শাসনতন্ত্রের প্রধান প্রধান বিধানগুলো পরিষদের বাইরে ছোট ছোট বৈঠকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো মীমাংসা করবেন।” পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌছুনোর জন্য ঢাকায় যান। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ফলপ্রসূ শাসনতন্ত্র সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনার জন্যই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টও বেশ কয়েকবার পূর্ব পাকিস্তান সফরে যান। তিনি শেখ জাতীয় পরিষদের ৯ টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ২১ টি ঘূর্ণ উপদ্রুত নির্বাচনী এলাকার নির্বাচন এক মাস পর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত হয়।