পাতা:বাংলাভাষা পরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাভাষা-পরিচয়

এই থাকার ভাবকে আশ্রয় করে। করেছে করছে করেছিল করছিল—শব্দগুলো ‘আছি’ ক্রিয়াপদকে ভিত্তি ক’রে স্থিতির অর্থকেই মুখ্য করেছে। সংস্কৃত ভাষায় এটা নেই, গৌড়ীয় ভাষায় আছে। হিন্দিতে বলে ‘চলা থা’, চলেছিল। কাজটা যদিও চলা, তব, থা শব্দে বলা হচ্ছে, চলার অবস্থাতে স্থিতি করেছিল। গতিটা যেন স্থিতির উপরেই প্রতিষ্ঠিত।

 যে কাজকে নির্দেশ করা হচ্ছে প্রধানত সেই কাজের মূল ধাতুকে দিয়েই ক্রিয়াপদের গড়ন। ‘খা’ ধাতুতে খাওয়া বোঝায়, খাওয়া কাজের সমস্ত ক্রিয়ার‍ূপ এই ধাতুর যোগেই তৈরি। কিন্তু বাংলা ভাষায় অনেক স্থলে কার্যটা ক্রিয়ার রূপ ধরে নি। ক্ষুধা পাওয়া, তৃষ্ণা পাওয়া, প্রতি দিনের ঘটনা; অথচ বাংলায় সেটা ক্রিয়ারূপ নেয় নি, বিশেষ্যের সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে বলতে হয়: ক্ষুধা পেল, তৃষ্ণা পেল। হওয়া উচিত ছিল ‘ক্ষধিল’ ‘তৃষিল', কাব্যে এইরকম ক্রিয়ারূপের কোনো বাধা নেই। কিন্তু গদ্যবাংলায় ক্রিয়াপদকে অনেক স্থলে গোটা বিশেষ্যপদের ভার বয়ে বেড়াতে হয়।

 বাংলায় দুটো ক্রিয়াপদ জুড়ে ক্রিয়াবিশেষণ গড়ার একটা রীতি আছে। তাতে যে ইঙ্গিতের ভাষা তৈরি হয়েছে তার ভাবপ্রকাশের শক্তি অসাধারণ। সামান্য এই কথাটা ‘রয়ে বসে কাজ করা’ যা বলে তা কোনো বাঁধা সংস্কৃত শব্দে বলাই যায় না। ‘উঠেপ’ড়ে’ ‘উঠেহেঁটে’ কিংবা ‘নেচেকুঁদে’ বেড়ানোতে যে ফুর্তি প্রকাশ পায় সেটার ঠিক উপযুক্ত শব্দ অভিধানে খুঁজে পাওয়া যায় না। এদের স্বজাতীয় শব্দ: তেড়েফুঁড়ে কেটেছঁটে বেঁচেবর্তে রয়েসয়ে হেসেখেলে। এমন আরও বিস্তর আছে। অনেক স্থলে ঐ জোড়া শব্দের দুটিতে অর্থের সাম্য থাকে না। বস্তুত ওগুলো শব্দযোজনার একরকম খেপামি। ‘বেয়েছেয়ে দেখা’য় যা বলা হচ্ছে তার সঙ্গে বাওয়া এবং ছাওয়ার কোনো সম্পর্কই নেই। যখন বলি ‘নেড়েচেড়ে দেখতে হবে’ তখন ‘নেড়ে’ শব্দের সহচরটিকে ব্যবহার করা হয় অর্থহীন বাটখারার

১০৬