পাতা:বাংলাভাষা পরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাভাষা-পরিচয়

ছোট্‌ থাম্‌ কাট্‌ মার্‌ ধর্‌ খেল্‌: এগুলি দৌড়দার শব্দ। আদিকালে ভাষায় ‘তু’ ‘তুই’ ছিল একমাত্র মধ্যমপুরুষের সর্ব‌নাম শব্দ। সেটা যদি চলে আসত তা হলে ক্রিয়াপদকে স্বরবর্ণ‌ এমন নরম করে রাখত না, হসন্ত ব্যঞ্জনবর্ণে‌ তাকে তীক্ষ্ণতা দিত। ‘করো’ হ’ত ‘কর্‌’। ‘কোরো’ হ’ত ‘করিস’। ‘দাঁড়া’ শব্দ যদিও স্বরবর্ণ‌ বহন করে তবু ‘দাঁড়াও’ শব্দের চেয়ে তার মধ্যে প্রভুশক্তি বেশি। ‘ঘুমো’ আর ‘ঘুমোও’ তুলনা করলে অনুজ্ঞার দিক থেকে প্রথমোক্তটির প্রবলতা মানতে হয়।

 চলতি বাংলা ভঙ্গীপ্রধান ভাষা, তার একটা লক্ষণ, ক্রিয়াপদের অনুজ্ঞায় অসংগত ভাবে ‘না’ শব্দের ব্যবহার। এর কাজ হচ্ছে আদেশ বা অনুরোধকে অনুনয়ে নরম করে আনা।

 ‘হোক না’ ‘করোই না’ ক্রিয়াপদে ‘না’ শব্দে নির্ব‌ন্ধ প্রকাশ পায়, কোনো-এক পক্ষের অনিচ্ছাকে যেন ঠেলে দেওয়া। ‘না’ শব্দের দ্বারা ‘হাঁ’ প্রকাশ করা আর প্রথমপুরুষ-বাচক ‘আপনি’কে মধ্যমপুরুষের অর্থে‌ ব্যবহার একই মনস্তত্ত্বমূলক। যিনি উপস্থিত আছেন যেন তিনি উপস্থিত নেই, তাঁর সঙ্গে মোকাবিলায় কথা বলার স্প‌র্ধা‌ বক্তার পক্ষে সম্ভব নয়, এই ভাণের দ্বারাই তাঁর উপস্থিতির মূল্য যায় বেড়ে। তেমনি অনুরোধ জানানোর পরক্ষণেই ‘না’ বলে তার প্রতিবাদ ক’রে অনুরোধের মধ্যে সম্মা‌নের কাকুতি এনে দেওয়া হয়। ‘না’ শব্দের ক্রিয়াপদের রূপ বাংলাভাষার আর-একটি বিশেষত্ব, যথা: আমি নই, তুমি নও, সে নয়, তিনি নন; আমি নেই, তুমি নেই, সে নেই, তিনি নেই; হই নে, হও না, হয় না, হন না, হয় নি, হন নি।

 বাংলা ক্রিয়াপদে নানারকম শব্দ-যোজনায় নানারকম ভঙ্গী। তার কতকগুলি সার্থক, কতকগুলি নিরর্থক। ক্রিয়াপদে এতরকম ইশারা বোধ হয় আর-কোনো ভাষায় নেই।

 পড়ল-বা, করলে-বা, শব্দে আশঙ্কার সূচনা। কোনো ক্রিয়াবিশেষণ-যোগে এর ভাবটা প্রকাশ হতে পারত না।

১১০