বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাভাষা পরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাভাষা-পরিচয়

 ‘সনে’ কথাটা এখন আর বলি নে, প্রাচীন পদাবলীতে ঐ অর্থে ‘সঙে’ কথা সর্বদা পাওয়া যায়। ‘নাহি জানি’ কথাটার ‘নাহি’ শব্দটা এখনকার নিয়মে ‘জানি’র সঙ্গে মিলতে পারে না। ‘নাহি’ শব্দের সংস্কৃত প্রতিশব্দ ‘নাস্তি’, চলিত কথায় ‘নেই’। ‘জানি’র সঙ্গে ‘নেই’ জোড়া যায় না, বলি ‘জানি নে’। ‘সাঁঝবেলা’ গ্রাম্যভাষায় এখনো চলে, কিন্তু যাদের জন্যে ঐ শ্লোকটা লেখা তাদের সঙ্গে আলাপে ‘সাঁঝবেলা’ শব্দটা বেখাপ। ‘বসিয়া’র জায়গায় ‘বসি’ আমরা বলি নে। যে শ্রেণীর লোকের ভাষায় ‘লেগে’ শব্দের ব্যবহার চলে তাদের খুশি করবার জন্যে দিগ্বধূ কখনো তারার মালা গাঁথেই না। ‘জন্যে’র পরিবর্তে ‘লাগি’ বা ‘লাগিয়া’ কিংবা ‘তরে’ শব্দটা ছন্দের মধ্যস্থতায় ছাড়া ভদ্রনামধারীদের রসনায় প্রবেশ পায় না। যেমতি তেমতি নেহারো উড়িলা হেরো মোরে পানে যবে হেথা সেথা নারে তারে প্রভৃতি শব্দ পদ্যের ফরমাশি।

 যদি বর্ষার দিনে বন্ধু এসে কথা জুড়ে দেয় ‘হেরো ঐ পুব দিকের পানে, রহি রহি বিজুলি চমক দেয়, মোর ডর লাগে, নাহি জানি কী লাগি সাধ যায় তোমা সনে একা বসি মনের কথা করি কানাকানি’, তবে এটাকে মধুরালাপের ভূমিকা বলে কেউ মনে করবে না, বন্ধুর জন্যে উদ্বিগ্ন হবে।

 তবু মন ভোলাবার ব্যবসায়ে পদ্য যদি সাদা ভাষার বাজে মালমশলা মেশায় তবে তাকে মাপ করা যায়, কিন্তু চলতি ব্যবহারে গদ্য যদি হঠাৎ সাধু হয়ে ওঠে তবে মহাপণ্ডিতেরাও মনে করবে, বিদ্রূপ করা হচ্ছে। কারও মাসির ’পরে বিশেষ সম্মান দেখাবার জন্যে কেউ যদি বিশুদ্ধ সাধু ভাষায় বলে ‘আপনার মাতৃষ্বসা আশা করি দুঃসাধ্য অতিসার ব্যাধি হইতে আরোগ্যলাভ করিয়াছেন’, তবে বোনপো ইংরেজের মুখে শুনলে মনে মনে হাসবে, বাঙালির মুখে শুনলে উচ্চহাস্য ক’রে উঠবে।

 তর্ক ওঠে, বাংলাদেশে কোন্‌ প্রদেশের ভাষাকে সাহিত্যিক

৪৬