পাতা:বাংলাভাষা পরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাংলাভাষা-পরিচয়

 ঘটিয়েছে। মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, দক্ষিণবঙ্গের কথ্য বাংলার কথা বলছি। এই ভাষায় 'করিলাম' যদি 'করলেম' হয়ে থাকে সে তার স্বরবর্ণের প্রবৃত্তিবশত। এই কারণেই 'হইয়া' হয়েছে 'হয়ে'।

  বাংলায় উ স্বরবর্ণও খুব চঞ্চল। ইকার টেনে আনে এ স্বরকে, আর ও স্বরকে টানে উকার: পট+উ আ=পোটাে। মাঝের উ ডাইনে বাঁয়ে দিলে স্বর বদলিয়ে। শব্দের আদ্যক্ষরে যদি থাকে 'আ তা হলে এই সব্যসাচী বাঁ দিকে লাগায় এ, ডান দিকে ও। 'মাঠ' শব্দে উআ প্রত্যয় যোগে ‘মাঠুআ', হ’য়ে গেল ‘মেঠো”; 'কাঠুআ’ থেকে 'কেঠো’। উকারের আত্মবিসর্জনের যেমন দৃষ্টান্ত দেখলুম, তার আত্মপ্রতিষ্ঠারও দৃষ্টান্ত আছে, যেমন: কুড়াল=কুড়ুল, উনান=উনুন। কোথাও বা আদ্যক্ষরের উকার পরবর্তী আকারকে ও ক’রে দিয়ে নিজে খাঁটি থাকে, যেমন: জুতা=জুতো, গুড়া= গুড়ো, পূজা=পুজো, সুতা=সুতো, ছুতার=ছুতোর, কুমার= কুমোর, উজাড়=উজোড়। উকারের পরবর্তী অকারকে অনেক স্থলেই উকার করে দেওয়া হয়, যেমন: পুতল=পুতুল, পুখের=পুখুর, হুকম=হুকুম, উপড়=উপুড়।

  একটা কথা বলে রাখি, ইকারের সঙ্গে উকারের একটা যোগ-সাজোস আছে। তিন অক্ষরের কোনো শব্দের তৃতীয় বর্ণে যদি ই থাকে তা হলে সে মধ্যবর্ণের আ'কে তাড়িয়ে সেখানে বিনা বিচারে উ’এর আসন করে দেয়। কিন্তু প্রথমবর্ণে উ কিংবা ই থাকা চাই, যেমন: উড়ানি=উড়ুনি, নিড়ানি=নিড়ুনি, পিটানি=পিটুনি। কিন্তু “পেটানি'র বেলায় খাটে না; কারণ ওটা একার, ইকার নয়। ‘মাতানি'র বেলায়ও এইরুপ। ‘খাটুনি’ হয়, যেহেতু ট'এ আকারের সংস্রব নেই। গাঁথুনি মাতুনি রাঁধুনি'রও উকার এসেছে অকারকে সরিয়ে দিয়ে। সেই নিয়মে: এখুনি চিরুনি। 'চালানি' শব্দে আকারকে মেরে উকার দখল পেলে না, কিন্তু ‘চালনি’ শব্দে অকারকে ঠেলে ফেলে অনায়াসে হল 'চালুনি’।

৬৫