পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলা শব্দতত্ব

হ্যর্নলে সাহেব-টাহেব আমি মানি না, বাংলায় এ-কার বিভক্তি কর্তৃকারকের বিভক্তি। আচ্ছা দেখা যাক, তেমন করিয়া মেলানো যায় কি না। ধনে শ্যামকে বশ করা গেছে, ইহার সংস্কৃত অনুবাদ ধনেন শ্যামো বশীকৃতঃ। কিন্তু বাংলাবাক্যটির কর্তা কে। ‘ধনে’ যদি কর্তা হইত, তবে ‘করা গেছে’ ক্রিয়া ‘করিয়াছে’ রূপ ধরিত। ‘তাহাকে [শ্যামকে]’ শব্দ কর্তা নহে, ‘কে’ বিভক্তিই তাহার সাক্ষ্য দিতেছে। কর্তা উহ্য আছে বলা যায় না; কারণ ‘করা গেছে’ ক্রিয়া কর্তা মানে না, আমরা করা গেছে, তাঁহারা করা গেছে, হয় না। অথচ ভাবার্থ দেখিতে গেলে, ‘বশ করা গেছে’ ক্রিয়ার কর্তা উহ্যভাবে আমরা। করা গেছে, খাওয়া গেছে, হওয়া গেছে, সর্বত্রই উত্তম পুরুষ। কিন্তু এই ‘আমরা’ কথাটাকে স্পষ্টভাবে ব্যবহার করিবার জো নাই; আমরা আয়োজন করা গেছে, বলিতেই পারি না। এইরূপ কর্তৃহীন কবন্ধবাক্য সংস্কৃত ভাষায় হয় না বলিয়া কি পণ্ডিতমশায় বাংলা হইতে ইহাদিগকে নির্বাসিত করিয়া দিবেন। তাহা হইলে ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড় হইবে। তাঁহাকে নাচিতে হইবে, কথাটার সংস্কৃত কী। তাং নতিতুং ভবিষ্যতি, নহে। যদি বলি, নাচিতে হইবে এক কথা, তবু ‘তাং নর্তব্যম’ হয় না। অতএব দেখা যাইতেছে, সংস্কৃতে যেখানে ‘তয়া নর্তব্যম’ বাংলায় সেখানে ‘তাহাকে নাচিতে হইবে’। ইহা বাংলা ব্যাকরণ না সংস্কৃত ব্যাকরণ? আমার করা চাই— এই ‘চাই’ ক্রিয়াটা কী। ইহার আকার দেখিয়া ইহাকে উত্তমপুরুষ বোধ হয়, কিন্তু সংস্কৃতে ইহাকে ‘মম করণং যাচে’ বলা চলে না। বাংলাতেও ‘আমি আমার করা চাই’ এমন কখনো বলি না। বস্তুত ‘আমার করা চাই’ যখন বলি, তখন অধিকাংশ সময়েই সেটা আমি চাই না, পেয়াদায় চায়। অতএব এই ‘চাই’ ক্রিয়াটা সংস্কৃত ব্যাকরণের কোন্ জিনিসটার কোন সম্বন্ধী। আমাকে তোমার পড়াতে হবে, এখানে ‘তোমার’ সর্বনামটি সংস্কৃত কোন্ নিয়মমতে সম্বন্ধপদ হয়। এই বাক্যের অনুবাদ ত্বং মাং পাঠয়িতুম অর্হসি; এখানে ত্বং কর্তৃকারক ও প্রথমা এবং অর্হসি মধ্যমপুরুষ—কিন্তু বাংলায় ‘তোমার’ সম্বন্ধপদ এবং ‘হবে’ প্রথমপুরুষ। সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মে এ-সকল বাক্য সাধা অসাধ্য, বাংলা ভাষার নিয়মে এগুলিকে পরিত্যাগ করা ততোধিক অসাধ্য। পণ্ডিতমশায় কোন্ পথে যাইবেন। ‘আমাকে তোমার পড়াতে হবে’ বাক্যটির প্রত্যেক শব্দই সংস্কৃতমূলক, অথচ ইহার প্রত্যেক শব্দটিতেই সংস্কৃত নিয়ম লঙ্ঘন হইয়াছে।