পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১০
বাংলা শব্দতত্ব

প্রয়োজনমত আমরা উহাকে বাংলা প্রত্যয়ের ছাঁচে ঢালিয়া তৈরি করিয়া লইয়াছি। মাস্টার কথা আমরা ইংরেজি হইতে পাইয়াছি, কি মাস্টারি (মাস্টার-বৃত্তি) কথায় আমরা বাংলা ই প্রত্যয় ঘােগ করিয়াছি; এই ই ইংরেজি mastery শব্দের y নহে। সংস্কৃত ছাঁদে বাংলা লিখিবার সময় কেহ যদি ‘ভাে স্বদেশিন্’ লেখেন, তাঁহাকে অনেক পণ্ডিত সমালােচক প্রশংসা করিবেন, কিন্তু কেহ যদি ‘ভাে বিলাতিন’ লিখিয়া রচনার গাম্ভীর্যসঞ্চার করিতে চান, তবে ঘরে-পরে সকলেই হাসিয়া উঠিবে। কেহ বলিতে পারেন ‘বিলাতি’ সংস্কৃত ই প্রত্যয়, ইন প্রত্যয় নহে। আচ্ছা, দোকান যাহার আছে সেই ‘দোকানি’কে সম্ভাষণ-কালে ‘দোকানিন্’ এবং তাহার স্ত্রীকে ‘দোকানিনী’ বলা যায় কি।

 আর-একটা দৃষ্টান্ত দিই। বাংলায় ‘রাগ’ শব্দের অর্থ ক্রোধ; সেই ‘রাগ’ শব্দের উত্তর ই প্রত্যয়ে ‘রাগি’ হয়। কিন্তু প্রাচীন বৈষ্ণব পদাবলীর কাল হইতে আজ পর্যন্ত পণ্ডিত অপণ্ডিত কেহই রুষ্ট স্ত্রীলােককে “রাগিণী” বলিয়া সম্ভাষণ করেন নাই।

 গোবিন্দদাস রাধিকার বর্ণনাস্থলে লিখিয়াছেন::::::নব অনুরাগিণী অখিল সােহাগিনী::::::পঞ্চম রাগিণী মােহিনী রে!

 গোবিন্দদাস মহাশয়ের বলিবার অভিপ্রায় এরূপ নহে যে, রাধিকার রাগ সর্বদা পঞ্চমেই চড়িয়া আছে। ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, সংগীতের “রাগিণী’ কথাটা সংস্কৃত প্রত্যয়ের দ্বারা তৈরি। ‘অনুরাগী’ কথাটাও সেইরূপ।

 পণ্ডিতমশায় বলিবেন, সে যেমনই হউক, এ-সমস্তই সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার হইতে উৎপন্ন; আমিও সে কথা স্বীকার করি। প্রমাণ হইয়াছে, একই মূল হইতে ‘হংস’ এবং ইংরেজি ‘গ্যাণ্ডার’ শব্দ উৎপন্ন। কিন্ত তাই বলিয়া ‘গ্যাণ্ডার’ সংস্কৃত ‘হংস’ শব্দের ব্যাকরণগত নিয়ম মানে না, এবং তাহার স্ত্রীলিঙ্গে ‘গ্যাণ্ডারী’ না হইয়া ‘গূস্’ হয়। ইহাও প্রমাণ হইয়াছে, একই আর্যপিতামহ হইতে বপ্, বার্নুফ, প্রভৃতি য়ুরােপীয় শাব্দিক ও বাঙালি ব্যাকরণজ্ঞ পণ্ডিত জন্মিয়াছেন, কিন্তু য়ুরোপীয় পণ্ডিতরা ব্যাকরণকে যে-বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপকভাবে দেখেন, আমাদের পণ্ডিতরা তাহা দেখেন না; অতএব উৎপত্তি এক হইলেও ব্যুৎপত্তি ভিন্ন প্রকারের হওয়া অসম্ভব নহে। ইন্ প্রত্যয় হইতে বাংলা ই প্রত্যয়