পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫৪
বাংলা শব্দতত্ত্ব

সত্ত্বেও man শব্দ বহুবচনরূপ গ্রহণ করিয়া men হয়— সংস্কৃতে অনেকা লােকাঃ, কিন্তু বাংলায় অনেক লােকগুলি হয় না।

 অথচ ‘সকল’ বিশেষণের যােগে বিশেষ্যপদ বিকল্পে বহুবচনরূপও গ্রহণ করে। আমরা বলিয়া থাকি, সকল সভ্যেরাই এসেছেন— সকল সভ্যই এসেছেন এরূপও বলা যায়। কিন্তু অনেক সভ্যেরা এসেছেন কোনােমতেই বলা চলে না। ‘সব’ শব্দও ‘সকল’ শব্দের ন্যায়। ‘সব পালােয়ানরাই সমান’ এবং ‘সব পালােয়ানই সমান’ দুই চলে।

 ‘বিস্তর’ শব্দ ‘অনেক’ শব্দের ন্যায়। অর্থাৎ এই বিশেষণ পূর্বে থাকিলে বিশেষ্যপদ আর বহুবচন রূপ গ্রহণ করে না—‘বিস্তর লােকেরা’ বলা চলে না।

 এইরূপ আর-একটি শব্দ আছে তাহা লিখিত বাংলায় প্রায়ই ব্যবহৃত হয় না— কিন্তু কথিত বাংলায় তাহারই ব্যবহার অধিক, সেটি ‘ঢের’। ইহার নিয়ম ‘বিস্তর’ ও ‘অনেক’ শব্দের ন্যায়ই। ‘গুচ্ছার’ শব্দও প্রাকৃত বাংলায় প্রচলিত। ইহা প্রায়ই বিরক্তি-প্রকাশক। যখন বলি গুচ্ছার লােক জমেছে তখন বুঝিতে হইবে সেই লােকসমাগম প্রীতিকর নহে। ইহা সম্ভবত গােটাচার শব্দ হইতে উদ্ভূত।

 সংখ্যাবাচক বিশেষ্য পূর্বে যুক্ত হইলে বিশেষ্যপদ বহুবচনরূপ গ্রহণ করে না। যেমন, চার দিন, তিন জন, দুটো আম।

 গণ, দল, সমূহ, বৃন্দ, বর্গ, কুল, চয়, মালা, শ্রেণী, পঙ্ক্তি প্রভৃতি শব্দযোগে বিশেষ্যপদ বহুত্ব অর্থ গ্রহণ করে। কিন্তু ইহা সংস্কৃত রীতি। এইজন্য অবিকৃত সংস্কৃত শব্দ ছাড়া অন্যত্র ইহার ব্যবহার নাই। বস্তুত ইহাদিগকে বহুবচনের চিহ্ন বলাই চলে না। কারণ ইহাদের সম্বন্ধেও বহুবচনের প্রয়ােগ হইতে পারে— যেমন সৈন্যগণেরা, পদাতিক দলেরা ইত্যাদি। ইহারা সমষ্টিবােধক।

 ইহাদের মধ্যে ‘গণ’ শব্দ প্রাকৃত বাংলার অন্তর্গত হইয়াছে। এইজন্য ‘পদাতিকগণ’ এবং ‘পাইকগণ’ দুই বলা চলে। কিন্তু ‘লাঠিয়ালবৃন্দ’ ‘কলুকুল’ বা ‘আটচালাচয়’ বলা চলে না।

 গণ, মালা, শ্রেণী ও পঙ্ক্তি শব্দ সর্বত্র ব্যবহৃত হইতে পারে না। গণ ও দল কেবল প্রাণীবাচক শব্দের সহিতই চলে। কখনাে কখনাে রূপকভাবে মেঘদল তরঙ্গদল বৃক্ষদল প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। মালা, শ্রেণী ও পঙ্ক্তি শব্দের অর্থ অনুসারেই তাহার ব্যবহার, এ কথা বলা বাহুল্য।