পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২০৮
বাংলা শব্দতত্ত্ব

 বৈদিক সাহিত্যে সংস্কৃতি শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়, তাতে শিল্প সম্বন্ধেও সংস্কৃতি শব্দের প্রয়োগ আছে। ‘আত্মসংস্কৃতির্বাব শিল্পানি।’ এ’কে ইংরেজি করা যেতে পারে, Arts indeed are the culture of soul। ‘ছন্দোময়ং বা এতৈর্যজমান আত্মানং সংস্কুরুতে’— এই-সকল শিল্পের দ্বারা যজমান আত্মার সংস্কৃতি সাধন করেন। সংস্কৃত ভাষা বলতে বোঝায় যে ভাষা বিশেষভাবে cultured, যে ভাষা cultured সম্প্রদায়ের। মারাঠি হিন্দী প্রভৃতি অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষায় সংস্কৃতি শব্দটাই কাল্‌চার অর্থে স্বীকৃত হয়েছে। সাংস্কৃতিক ইতিহাস (cultural history) ক্রৈষ্টিক ইতিহাসের চেয়ে শোনায় ভালো। সংস্কৃত চিত্ত, সংস্কৃত বুদ্ধি cultured mind, cultured intelligence অর্থে কৃষ্টচিত্ত কৃষ্টবুদ্ধির চেয়ে উৎকৃষ্ট প্রয়োগ সন্দেহ নেই। যে মানুষ cultured তাকে কৃষ্টিমান বলার চেয়ে সংস্কৃতিমান বললে তার প্রতি সম্মান করা হবে।[১]

  1. প্রবাসী ভাদ্র ১৩৪২ সংখ্যায় এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হইলে প্রবাসী আশ্বিন সংখ্যায় যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি এই প্রসঙ্গে লেখেন—
     “Culture of mind অর্থে কৃষ্টি শব্দ প্রচলিত হয়েছে। গত ভাদ্রের প্রবাসীতে রবীন্দ্রনাথ আপত্তি তুলেছেন।
     বোধ হয়, প্রথমে আমি কৃ-ষ্টি শব্দ প্রয়োগ করি। সে দশ-বার বৎসর পূর্বের কথা। আমি এখনও কৃ-ষ্টি লিখে থাকি। সং-স্কৃ-তি দেখেছি, কিন্তু আমার মনে লাগে নি। সং-স্কৃ-তি ও সং-স্কা-র অর্থে এক। সং-স্কা-র শব্দের নানা অর্থ আছে। মেদিনীকোষ তিনটি মূলার্ধ দিয়েছেন -প্রতিযত্ন, অনুভব, মানসকর্ম। কৃ-ষ্টি শব্দের এত ব্যাপক অর্থ নাই।
     অমরকোষে পণ্ডিত শব্দের বত্রিশটি সমার্থ শব্দ আছে। তন্মধ্যে কৃ-ষ্টি একটা। মেদিনীকোষ কৃ-ষ্টি শব্দের দুইটা অর্থই ধরেছেন, পুংলিঙ্গে ‘বুধ’, স্ত্রীলিঙ্গে ‘আকর্ষ’। ভূমির কর্ষণ হয়, চিত্ত ভূমিরও কর্ষণ হতে পারে। রামপ্রসাদ তার সাক্ষী।
      পশ্চিমদেশের সংস্পর্শে সে দেশের নানা সংস্কার আসছে নুতন নূতন শব্দও রচিত হচ্ছে। ভাগ্যক্রমে কৃ-ষ্টি নব-রচিত নয়, কিন্তু অর্থে অবিকল culture।”
     বিদ্যানিধি মহাশয় মেদিনীকোষ ও অমরকোষের উল্লেখ করিয়াছিলেন, এইসূত্রে, মনিয়ার বিলিয়ম্‌সের অভিধান হইতে সংস্কৃতি, কৃষ্টি প্রভৃতি শব্দের যে-সকল প্রতিশব্দ রবীন্দ্রনাথ উদ্‌ধৃত করেন, এই আলোচনার তৃতীয় নিবন্ধরূপে তাহা মুদ্রিত হইল।
     এটি “কালচার” নামে প্রবাসী ১৩৪২ ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ইহার অংশবিশেষ বাংলা শব্দতত্ত্বের দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণে (অগ্রহায়ণ ১৩৪২) ‘ভাষার খেয়াল’ নামে এক স্বতন্ত্র প্রবন্ধাকারে সংকলিত