পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২১৮
বাংলা শব্দতত্ত্ব

‘যে’ সর্বনাম শব্দের প্রয়োগ সম্বন্ধে পূর্বেই আমাদের বক্তব্য জানাইয়াছি।

 আমাদের তরজমা: ‘ভাগ্যক্রমে বৃক্ষের শত্রু-কীট-সকলেরও নিজেদের নিত্যশক্রর অভাব নাই; এই শত্রুদের মধ্যে এমন অনেক জাতীয় পাখি আছে যাহাদের যুদ্ধোপকরণ এবং অভ্যাস সকল কীট-আক্রমণের পক্ষে বিশেষ উপযোগী এবং যাহারা কীট শিকারেই সমস্ত জীবন যাপন করে।’

 ইংরেজিতে persistent কথাটি নিতান্ত সহজ। কথ্য বাংলায় আমরা বলি নাছোড়বান্দা। কিন্তু লেখায় সব জায়গায় ইহা চলে না। আমাদের একজন পত্রলেখক ‘দৃঢ়াগ্রহ’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। কিন্তু ‘আগ্রহ’ শব্দে, অন্তত বাংলায়, প্রধানত একটি মনোধর্ম বুঝায়। নিষ্ঠা শব্দেও সেইরূপ। Persistent শব্দের অর্থ, যাহা নিরস্তর লাগিয়াই আছে। ‘নির্বদ্ধ’ শব্দটিতে সেই লাগিয়া থাকা অর্থ আছে; ‘দৃঢ়নির্বদ্ধ’ কথাটা বড়ো বেশি অপরিচিত। এখানে কেবল মাত্র ‘নিত্য’ বিশেষণ যোগে ইংরেজি শব্দের ভাব স্পষ্ট হইতে পারে।

 আমাদের আলোচ্য ইংরেজি প্যারাগ্রাফে একটি বাক্য আছে ‘among them are many species of birds’; আমাদের একজন ছাত্র এই species শব্দকে ‘উপজাতি’ প্রতিশব্দ দ্বারা তরজমা করিয়াছে। গতবারে ‘প্রতিশব্দ’ প্রবন্ধে[১] আমরাই speciesএর বাংলা ‘উপজাতি’ স্থির করিয়াছিলাম অথচ আমরাই এবারে কেন many ‘species of birds’কে ‘নানাজাতীয় পক্ষী’ বলিলাম তাহার কৈফিয়ত আবশ্যক। মনে রাখিতে হইবে এখানে ইংরেজিতে species পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করা হয় নাই। এখানে কোনো বিশেষ একটি মহাজাতীয় পক্ষীরই উপজাতিকে লক্ষ্য করিয়া species কথা বলা হয় নাই। বস্তুত কীটের যে-সব শক্র আছে তাহারা নানা জাতিরই পক্ষী— কাকও হইতে পারে শালিকও হইতে পারে, শুধু কেবল কাক এবং দাঁড়কাক শালিক এবং গাঙশালিক নহে। বস্তুত সাধারণ ব্যবহারে অনেক শব্দ আপন মর্যাদা লঙ্ঘন করিয়া চলে, কেহ তাহাতে আপত্তি করে না, কিন্তু পারিভাষিক ব্যবহারে কঠোরভাবে নিয়ম মানিয়া চলিতে হয়। যেমন বন্ধুর নিমন্ত্রণক্ষেত্রে মানুষ নিয়মের দিকে দৃষ্টি রাখে না, সামাজিক নিমন্ত্রণে তাহাকে নিয়ম বাঁচাইয়া চলিতে হয়— এও সেইরূপ।

  1. দ্রষ্টব্য: প্রতিশব্দ ১, পৃ. ১৮৩-১৮৫