পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলা কথ্যভাষা
২২৯

এই একটা বিদ্‌ঘুটে অসামঞ্জস্যটাকে মিলিয়ে দেওয়া যেতে পারে। বিদ্যাসাগর তাকে কিছু পরিমাণে মোলায়েম ক’রে আনলেন—কিন্তু বঙ্গবাণী তবু বললেন “এহ বাহ্য”। তার পরে এলেন বঙ্কিম। তিনি ভাষার সাধুতার চেয়ে সত্যতার প্রতি বেশি ঝোঁক দেওয়াতে তখনকার কালের পণ্ডিতেরা দুই হাত তুলে বোপদেব অমরের দোহাই পেড়েছিলেন। সেই বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনীর ভাষাও আজ প্রায় মরা গাঙের ভাষা হয়ে এসেচে—এখনকার সাহিত্যে ঠিক সে ভাষার স্রোত চলচে না। অর্থাৎ বাংলা গদ্যসাহিত্যের গোড়ায় যে একটা original sin ঘটেছে কেবলি সেটাকে ক্ষালন করতে হচ্চে। কৌলিন্যের অভিমানে যে একটা হঠাৎ সাধুভাষা সর্বসাধারণের ভাষার সঙ্গে জল-চল বন্ধ ক’রে কোণ-ঘেঁষা হয়ে বসেছিল, অল্প অল্প ক’রে তার পঙ্‌ক্তিভেদ ভেঙে দেওয়া হচ্চে। তার জাত যায়-যায়। উভয় ভাষায় কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে অসবর্ণ বিবাহ হতে শুরু হয়েচে। এখন আমরা চলিত কথায় অনায়াসে বলতে পারি ‘ম্যালেরিয়ায় কুইনীন ব্যবহার করলে সদ্য ফল পাওয়া যায়।’ পঞ্চাশ বছর আগে লোকের সঙ্গে ব্যাভার ছাড়া ব্যবহার কথাটা অন্য কোনো প্রসঙ্গেই ব্যবহার করতুম না। তখন বলতুম, ‘ম্যালেরিয়ায় কুইনীনটা খুব খাটে।’ আমার মনে আছে, আমার বাল্যকালে আমাদের একজন চাকরের মুখে ‘অপেক্ষা’ কথাটা শুনে আমাদের গুরুজনরা খুব হেসেছিলেন। কেননা, কেউ অপেক্ষা করচেন, এ কথাটা তাঁরাও বলতেন না—তাঁরা বলতেন ‘অমুক লোক তোমার জন্যে বসে আছেন।’ আবার এখানকার লেখার ভাষাতেও এমনি করেই মুখের ভাষার ছাঁদ কেবলি এগিয়ে চলছে। এক ভাষার দুই অঙ্গের মধ্যে অতি বেশি প্রভেদ থাকলে সেই অস্বাভাবিক পার্থক্য মিটিয়ে দেবার জন্যে পরস্পরের মধ্যে কেবলি রফা চলতে থাকে।

 এ কথা সত্য ইংরেজিতেও মুখের ভাষায় এবং লেখার ভাষায় একেবারে ষোলো-আনা মিল নেই। কিন্তু মিলটা এতই কাছাকাছি যে পরস্পরের জায়গা অদলবদল করতে হলে মস্ত একটা লাফ দিতে হয় না। কিন্তু বাংলায় চলতি ভাষা আর কেতাবী ভাষা একেবারে এপার ওপার—ইংরেজিতে সেটা ডান হাত বাঁ হাত মাত্র-একটাতে দক্ষতা বেশি আর-একটাতে কিছু কম—উভয়ে একত্র মিলে কাজ করলে বেমানান হয় না। আমি কোনো কোনো বিখ্যাত ইংরেজ লেখকের ডিনার-টেবিলের আলাপ শুনেছি, লিখে নিলে ঠিক তাঁদের বইয়ের ভাষাটাকেই