পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাভাষা ও বাঙালি চরিত্র : ১
৩১৩

আনয়ন করে তাহা বিশুদ্ধ smile নহে, ঈষদ্ধাস্য কোনাে ছরি আনয়ন করে কি সন্দেহ। Peep শব্দকে বাংলায় ‘উঁকিমারা’ বলিতে হয়। Creep শব্দকে ‘গুঁড়িমারা’ বলিতে হয়। কিন্তু ‘উঁকিমারা’, ‘গুঁড়িমারা’ শব্দ ভাবপ্রকাশক হইলেও সর্বত্র ব্যবহারযােগ্য নহে। কারণ উক্ত শব্দগুলিতে আমাদের মনে এমনসকল ছবি আনয়ন করে যাহার সহিত কোনাে মহৎ বর্ণনার যােগসাধন করিতে পারা যায় না।

 হিন্দুস্থানী বা মুসলমানদের মধ্যে একটা আদব-কায়দা আছে। হিন্দুস্থানী বা মুসলমান ভৃত্য দিনের মধ্যে প্রভুর সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হইবা মাত্রই যে সেলাম অথবা নমস্কার করে তাহার কারণ এমন নহে যে, তাহাদের মনে বাঙালি ভৃত্যের অপেক্ষা অধিক দাস্যভাব আছে, কিন্তু তাহার কারণ এই যে, সভ্যসমাজের সহস্রবিধ সম্বন্ধের ইতিকর্তব্য বিষয়ে তাহারা নিরলস ও সতর্ক। প্রভুর নিকটে তাহারা পরিচ্ছন্ন পরিপাটি থাকিবে, মাথায় পাগ্‌ড়ি পরিবে, বিনীত ভাব রক্ষা করিবে। স্বাভাবিক ভাবে থাকা অপেক্ষা ইহাতে অনেক আয়াস ও শিক্ষা আবশ্যক। আমরা অনেক সময়ে যাহাকে স্বাধীন ভাব মনে করি তাহা অশিক্ষিত অসভ্য ভাব। অনেক সময়ে আমাদের এই অশিক্ষিত ও বর্বর ভাব দেখিয়াই ইংরাজেরা আমাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়, অথচ আমরা মনে মনে গর্ব করি যেন প্রভুকে যথাযােগ্য সম্মান না দেখাইয়া আমরা ভারি একটা কেল্লা ফতে করিয়া আসিলাম। এই অশিক্ষা ও অনাচারবশত আমাদের দৈনিক ভাষা ও কাজের মধ্যে একটি সুমার্জিত সুষমা একটি শ্রী লক্ষিত হয় না। আমরা কেমন যেন ‘আট-পৌরে’ ‘গায়েপড়া’ ‘ফেলাছড়া’ ‘ঢিলেঢালা’ ‘নড়বোড়ে’ রকমের জাত, পৃথিবীর কাজেও লাগি না, পৃথিবীর শােভাও সাধন করি না।

২২ কার্তিক ১৮৮৮ প্রকাশ: বৈশাখ ১৩১২

বাংলা ভাষায় কবিতা রচনা করিতে গিয়া একটি প্রধান ব্যাঘাত এই দেখিতে পাই, বাংলা ভাষায় ছবি আঁকা শব্দ অতি অল্প। কেবল উপ্‌রি-উপ্‌রি মােটামুটি একটা বর্ণনা করা যায় মাত্র, কিন্তু একটা জাজ্বল্যমান মূর্তি ফুটাইয়া তুলা যায়