পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩১৮
বাংলা শব্দতত্ত্ব

তার কোন চিহ্ন নেই; সে-সব জায়গায় ব্রাহ্মণের চেয়ে কুলীনের চেয়ে অনেক বড় মান সর্বদাই অন্য জাতের লোক পেয়ে থাকে। অতএব আজকের দিনে জনসমাজে কার কোন আসন সেটা জাতের দ্বারা ঘের দিয়ে সুরক্ষিত নেই, ভোজের স্থানেও পঙ্‌ক্তি-বিভাগের দাগটা কোথাও বা লুপ্ত, কোথাও বা অত্যন্ত ফিকে। মানুষের পরিচয়ে জাত-পরিচয়ের দাম এক সময়ে যত বড়ো ছিল এখন তা প্রায় নেই বলা যেতে পারে।

 দাম যখন বেশি ছিল, এমন-কি,সম্মানের বাজারে সেইটেই যখন প্রায় একান্ত ছিল তখন নামের সঙ্গে পদবী বহন করাটা বাহুল্য ছিল না। কেননা আমাদের পদবী জাতের পদবী। ইংরেজিতে স্মিথ পদবী পারিবারিক, যদিও ছড়িয়ে গিয়ে এর পারিবারিক বিশেষত্ব অনেক পরিমাণে হারিয়ে গেছে। কিন্তু ঘোষ বোস চাটুজ্যে বাঁড়ুজ্যে মূলত কোনো পরিবারকে নির্দেশ করে না, জাতবিশেষের বিভাগকে নির্দেশ করে। পরিবারের চেয়ে এই বিভাগটা অনেক ব্যাপক। এমনতর ব্যাপক সংজ্ঞার যখন বিশেষ মূল্য ছিল তখনি নামের সঙ্গে ব্যবহারে সেটার বিশেষ সার্থকতা ছিল, এখন মূল্য যতই কমে আসছে ততই পারিবারিক পরিচয় হিসাবে ওর বিশিষ্টতা থাকছে না, অন্য হিসাবেও নয়।

 ভারতবর্ষে বাংলা দেশ ছাড়া প্রায় সকল প্রদেশেই পদবীহীন নাম বিনা উপদ্রবেই চলে আসছে। এতদিন তো তা নিয়ে কারো মনে কোনো খট্‌কা লাগে নি। বারাণসীর স্বনামখ্যাত ভগবানদাস তাঁর ব্যক্তিগত নামটুকু নিয়েই আছেন। তাঁর ছেলের নাম শুদ্ধমাত্র শ্রীপ্রকাশ, নামের সঙ্গে কুলপরিচয় নেই। রাষ্ট্রিক উদ্যোগে খ্যাতিলাভের দ্বারা তিনি আপন নিষ্পদবিক নামটিকেই জনাদৃত করে তুলছেন।

 প্রাচীনকালের দিকে তাকালে নল-দময়ন্তী বা সাবিত্রী-সত্যবানের কোন পদবী দেখা যায় না। একান্ত আশা করি, নলকে নলদেববর্মা বলে ডাকা হত না। কুলপদবীর সমাসযোগে যুধিষ্ঠির-পাণ্ডব বা দ্রৌপদী-পাণ্ডব নাম পুরাণ-ইতিহাসে চলে নি, সমাজে চলতি ছিল এমন প্রমাণ নেই। বিশেষ প্রয়োজন হলে ব্যক্তিগত নামের সঙ্গে আরো কিছু বিশেষণ যোগ করা চলত। যেমন সাধারণত ভগবান মনুকে শুদ্ধ মনু নামেই আখ্যাত করা হয়েছে, তাতে অসুবিধা ঘটে নি― তবু বিশেষ প্রয়োজনস্থলেই তাঁকে বৈবস্বত মনু বলা হয়ে থাকে, সর্বদা নয়।