পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভাষাবিচ্ছেদ
৫১

  অথচ আশ্চর্য এই যে, মূর্ধন্য য আসামি ভাষায় খ-এর ন্যায় উচ্চারিত হয়, ইহা ছাড়া আসামির সহিত হিন্দুস্থানির আর-কোনো সাদৃশ্য নাই এবং তাহার সমস্ত সাদৃশ্যই বাংলার সহিত।

  অকারের বিশুদ্ধ উচ্চারণই হিন্দুস্থানির প্রধান বিশেষত্ব, হিন্দুস্থানিতে বট শব্দ ইংরেজি but শব্দের অনুরূপ, বাংলায় তাহা ইংরেজি bought শব্দের ন্যায়। পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য গৌড়ীয় উচ্চারণের সহিত প্রাচ্য গৌড়ীয়ের এই সর্বপ্রধান প্রভেদ। আসামি ভাষা এ-সম্বন্ধে বাংলার মতো। ঐকারের উচ্চারণেও তাহা দেখা যায়। বাংলা ঐ ইংরেজি stoic শব্দের oi, হিন্দি ‘ঐ’ ইংরেজি style শব্দের y। ঔ শব্দও তদ্রূপ।

  বাংলার অকার উচ্চারণ স্থানবিশেষে; যথা, ইকার উকারের পূর্বে হ্রস্ব ওকারে পরিণত হয়। কল, কলি ও কলু শব্দের উচ্চারণভেদ আলোচনা করিলেই তাহা বোধগম্য হইবে। আসামি ভাষার উচ্চারণে বাংলার এই বিশেষত্ব আছে।

  আসামিতে ইকারের পূর্বে ওকার প্রায় উকারে পরিণত হয়; যথা, ‘বোলে’ ক্রিয়া (বাংলা, বলে) বিভক্তিপরিবর্তনে ‘বুলিছে’ হয়। বাংলাতেও, খোলে খুলিছে, দোলে দুলিছে। বোল বুলি, খোল খুলি, ঝোলা ঝুলি, গোল গুলি, ইত্যাদি।

  যুক্ত অক্ষয়ের উচ্চারণেও প্রভেদ দেখি না, আসামিরাও স্মরণ-কে স্বরণ, স্বরূপ-কে সরূপ, পক্ষী-কে পক্‌খী বলে।

  অন্ত্যস্থ ৱ সম্বন্ধে বক্তব্য এই যে, বাংলাতেও এই উচ্চারণ আছে, কিন্তু বগীয় ব ও অন্ত্যস্থ ৱ-এ অক্ষরের ভেদ নাই, আসামিতে সেই ভেদচিহ্ন আছে। তাহা বলিয়া এ কথা কেহ মনে করিবেন না, মহারাষ্ট্রীদের ন্যায় আসামিরা সংস্কৃত শব্দে অন্ত্যস্থ ও বগীয় ব-এর প্রভেদ রক্ষা করিয়া থাকে। আমরা যেখানে ‘পাওয়া’ লিখি আসামিরা সেখানে ‘পৱা’ লেখে। আমাদের ওয়া এবং তাহাদের ৱা উচ্চারণে একই, লেখায় ভিন্ন।

  যাহাই হউক, যে-ভাষা ভ্রাতাদের মধ্যে অবাধ ভাবপ্রবাহ সঞ্চারের জন্য হওয়া উচিত, তাহাকেই প্রাদেশিক অভিমান ও বৈদেশিক উত্তেজনায় পরস্পরের মধ্যে ব্যবধানের প্রাচীরস্বরূপে দৃঢ় ও উচ্চ করিয়া তুলিবার যে-চেষ্টা তাহাকে স্বদেশহিতৈষিতার লক্ষণ বলা যায় না এবং তাহা সর্বতোভাবে অশুভকর।

  শ্রাবণ ১৩০৫