পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৬
বাংলা শব্দতত্ত্ব

  প্রথমেই মনে হয়, বিশেষণ শব্দ বিশেষরূপে অকারান্ত উচ্চারিত হইবে, এ নিয়মের কোনো সার্থকতা নাই। অতএব, ছোট বড় ভাল প্রভৃতি বিশেষণ শব্দ যে সাধারণ বাংলা শব্দের ন্যায় হসন্ত হয় নাই, তাহার কারণটা ওই শব্দগুলির মুল সংস্কৃত শব্দে পাওয়া যাইবে। ‘ভালো’ শব্দ ভদ্র শব্দজ, ‘বড়ো’ বৃদ্ধ হইতে উৎপন্ন, ‘ছোটো’ ক্ষুদ্র শব্দের অপভ্রংশ। মূল শব্দগুলির শেষবর্ণ যুক্ত, —যুক্তবর্ণের অপভ্রংশে হসন্ত বর্ণ না হওয়ারই সম্ভাবনা।

 কিন্তু এ নিয়ম খাটে না। নৃত্য-র অপভ্রংশ নাচ, পঙ্ক—পাঁঁক, অঙ্ক—আঁক, রঙ্গ—রাং, ভট্ট—ভাট, হস্ত—হাত, পঞ্চ—পাঁঁচ ইত্যাদি।

 অতএব নিশ্চয়ই বিশেষণের কিছু বিশেষত্ব আছে। সে বিশেষত্ব আরো চোখে পড়ে যখন দেখা যায়, বাংলার অধিকাংশ দুই-অক্ষরের বিশেষণ, যাহা সংস্কৃত মূল শব্দ অনুসারে অকারান্ত হওয়া উচিত ছিল, তাহা আকারান্ত হইয়াছে।

 যথা: সহজ—সোজা, মহৎ—মোটা, রুগ্ন—রোগা, ভগ্ন—ভাঙা, শ্বেত—শাদা, অভিষিক্ত—ভিজা, খঞ্জ—খোঁড়া, কাণ—কাণা, লম্ব—লম্বা, সুগন্ধ—সোঁঁধা, বক্র—বাঁকা, তিক্ত—তিতা, মিষ্ট—মিঠা, নগ্ন—নাগা, তির্যক্—টেড়া, কঠিন—কড়া।

  দ্রষ্টব্য এই যে, ‘কর্ণ’ হইতে বিশেষ্য শব্দ কান হইয়াছে, অথচ কান শব্দ হইতে বিশেষণ শব্দ কানা হইল। বিশেষ্য শব্দ হইল ফাঁঁক, বিশেষণ হইল ফাঁঁকা; বাঁঁক শব্দ বিশেষ্য, বাঁকা শব্দ বিশেষণ।

  সংস্কৃত ভাষায় ক্ত প্রত্যয়যোগে যেসকল বিশেষণ পদ নিম্পন্ন হয়, বাংলায় তাহা প্রায়ই আকারান্ত বিশেষণ পদে পরিণত হয়; ছিন্নবস্ত্র বাংলায়—ছেঁঁড়া বস্ত্র, ধূলিলিপ্ত শব্দ বাংলায়—ধুলোলেপা, কর্ণকর্তিত—কানকাটা ইত্যাদি।

 বিশেষ্য শব্দ চন্দ্র হইতে চাঁঁদ, বন্ধ হইতে বাঁঁধ, কিন্তু বিশেষণ শব্দ মন্দ হইতে হইল— মাদা। এক শব্দকে বিশেষরূপে বিশেষণে পরিণত করিলে ‘একা’হয়।

 এইরূপ বাংলা দুই-অক্ষরের বিশেষণ অধিকাংশই আকারান্ত। যেগুলি অকারান্ত, হিন্দিতে সেগুলিও আকারান্ত; যথা, ছোটা বড়া ভালা।

  ইহার একটা কারণ আমরা এখানে আলোচনা করিতেছি। স্বর্গগত উমেশচন্দ্র বটব্যালের রচনা হইতে দীনেশবাবু তাঁহার ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে নিম্নলিখিত ছত্রকয়টি উদ্‌ধৃত করিয়াছেন: