পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

সমালোচকেরা যা-ই বলুন না কেন, বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় যে-ভাবাদর্শ বহুস্বরিক ও অনেকার্থদ্যোতক প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠে—সর্বাত্মক মুক্তি-ই তার অন্বিষ্ট। ইতিহাসের চলমান ধারাকে যারা রচনা করে আবার নিজেরাই ঐ ধারা দ্বারা রচিত হয়—সেই প্রান্তিকায়িত নিম্নবর্গজনের নিত্যজায়মান প্রতিবেদন ভাবাদর্শকে কখনও রুদ্ধ হতে দেয় না। প্রতিভাবান স্রষ্টারা এই প্রক্রিয়াকে সূক্ষ্ম ও গভীরভাবে অনুধাবন করেন বলেই সমসাময়িক সরকারি বয়ান তাদের চেতনাকে গ্রাস করতে না পারে না কখনও। কার্নিভালের সূক্ষ্ম ও নিবিড় উপস্থিতি তাদের সঞ্জীবিত রাখে। পুশকিন বা ডস্টয়েভস্কির ক্ষেত্রে তা যতটা সত্য, গোর্কি ও ব্রেখটের ক্ষেত্রে ততটাই সত্য। শুধু নিজস্ব সময়ের অভিঘাতে তাদের পথ পরস্পর-ভিন্ন।

 বিভিন্ন উৎস-জাত প্রতিবেদনের মধ্যে যে-সব সীমান্ত সাধারণভাবে স্বীকৃত, কার্নিভাল তাদের মান্যতা দিতে অস্বীকার করে বলে সমাজের অবতল থেকে উঠে-আসা উপাদানের অভিঘাতে সেসব ক্রমাগত ভেঙে যায়। তত্ত্ববস্তু, অবভাস ও মূল্যমানের মধ্যে প্রচলিত অনড় সরকারি জলবিভাজন রেখা মুছে যায় ক্রমশ। বিভিন্ন শব্দের আন্তঃসম্পর্ক ও বাচনিক অভিব্যক্তির মধ্যে নতুন ধরনের দোলাচল দেখা দেয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক জগতের হওয়া ও হয়ে ওঠা, আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা, শ্লেষ ও বিষাদের মতো আপাত-বিপরীত প্রবণতাকেও অন্যোন্য-সম্পৃক্ত করে তোলে। ফলে পাঠকৃতির আস্তিত্বিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক সমস্যা নতুনভাবে নির্ধারিত হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। সরকারি বয়ানের রক্ষণশীলতায় যেসব অপূর্ণতা ও রুদ্ধতা অনাবিষ্কৃত ছিল, সেসব উদ্ঘাটিত হতে থাকে। আর, পাঠকৃতির মধ্যে অজ্ঞাতপূর্ব মুক্ত পরিসরের অস্তিত্ব প্রকট হতে শুরু করে। আভিজাত্য ও প্রতাপের মায়ায় মুগ্ধজনদের কাছে এই সত্য উন্মোচিত হয় যে—‘all peoples…have enormous spheres of speech that had not been made public and are non-existent from the point of view of literary written language.’ (তদেব: ৪২১)। লিখিত ভাষার যে মান্যতাপ্রাপ্ত সংরূপকে ‘সাহিত্যিক’ বলা হয়ে থাকে, সেই সাহিত্যিকতার স্বেচ্ছাকৃত নির্মিতি পুনরাবৃত্ত অভ্যাসে পরিণত হওয়ার ফলে কখন তা একবাচনিক মিথ্যার স্থাপত্য হয়ে উঠেছে, আমরা লক্ষই করি না। বরং তার অভিজাত অবস্থান থেকে অজ্ঞাত জীবনের বিপুল পরিধিকে মনে করি অস্তিত্বহীন। যাবতীয় অপর পরিসর ঐ সাহিত্যিকতার কাছে পুরোপুরি অবান্তর হয়ে পড়ে।

 তাই সেই পরিসর থেকে যখন আশ্চর্য বৈচিত্র্যযুক্ত বাচনের উপস্থিতি অপ্রত্যাশিতভাবে আবিষ্কৃত হয়, সযত্নরচিত সুবিধাজনক সামঞ্জস্যের বোধ আমূল পরিবর্তিত হয়ে যায়। আরোপিত গাম্ভীর্যের প্রতিষেধক হিসেবে যেন হাসি-পরিহাস-শ্লেষ-উদ্ভট আতিশয্য-প্রবণ গণআঙ্গিক ব্যবহৃত হয়। কার্নিভাল-চেতনাই এদের তাৎপর্যের নিয়ামক! এদের মধ্যে কোনো আনুগত্য বা চাহিদা থাকে না। অপ্রাতিষ্ঠানিক জীবন-প্রণালীর স্বতঃস্ফূর্ত হর্ষ-পুলক থেকে এদের উদ্ভব বলে গণমানসের মুক্ত পরিসরে যেন ‘আমরা সবাই রাজা’। প্রত্যেকেই কার্নিভালের নির্মাতা, আসলে প্রত্যেকেই স্বয়ং কার্নিভাল। যতক্ষণ কার্নিভাল আছে, এর বাইরে অন্য কোনো জীবন থাকে না। কার্নিভালের সময়ে ও পরিসরে জীবন নিজের নিয়ম নিজেই তৈরি করে। সেই নিয়ম স্বাধীনতার, মুক্তির, বাধাবন্ধনহীনতার। তাই বাখতিন বলেছেন: ‘Carnival is not a spectacle seen by the people; they live in it,

৯৯